দেশে করোনা মহামারি শুরুর আগে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ শুরু করেছিলেন আবদুল্লাহ নুহু। দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক চাকরি ছিল তার। তবে তার সবকিছু ওলটপালট করে দেয় করোনা। করোনাকালে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ায় হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েন নুহু।
মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। চাকরি না থাকায় খাবারের টাকা জোগাড় করাই মুশকিল হয়ে পড়ে নুহুর। ঘর ভাড়া বকেয়া পড়তে থাকে। ভাড়া পরিশোধের জন্য চাপ বাড়ে বাড়িওয়ালার। বাড়িওয়ালাকে বলেছিলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সব ভাড়া পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা নাছোড়বান্দা। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভাড়া বাকি রাখতে পারবেন না। অগত্যা ধারদেনা করে দুই মাসের ভাড়া পরিশোধ করে গত মে মাসের শেষের দিকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকা ছাড়েন নুহু।
এমন বেদনার গল্প শুধু নুহুর একার নয়; করোনাকালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের ঠিকানায় গিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আরও অনিশ্চিত সময় পার করছেন। সেখানেও কাজের অভাব। কীভাবে আগামীতে ঘুরে দাঁড়াবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবার জীবিকার ব্যবস্থা করা। শহর বা গ্রাম- সব জায়গার জন্যই এ কথা প্রযোজ্য। চাকরি ও কাজ হারিয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শহরে ফিরে আসার চেষ্টা করবেন। গ্রামে যে কাজের সংকট, এটা সাময়িক। পরিস্থিতি ভালো হলে গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকটি আবার শহরে ফেরত আসার চেষ্টা করবে- এটাই ঐতিহাসিক সত্য। যে কোনো দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার জনগোষ্ঠীর গ্রামে বসবাসের প্রবণতা কমে। এখন আমাদের দেশের ৩৫-৪০ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করছে। একটা সময় ৭০-৮০ শতাংশ বা তারও বেশি জনগোষ্ঠী হয়তো শহরে বসবাস করবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী শহরে বসবাস করছে। অথচ সপ্তদশ শতাব্দীতে দেশটির ৯৮ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করত।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'করোনাকালে কর্মহীন লোকদের টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে দেড় কোটি লোককে মাসে তিন-চার হাজার টাকা করে দিতে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলাম। আট-নয় মাস এভাবে সাহায্য দেওয়া যেত। আমাদের এই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, গ্রামেও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবকিছুতে প্রযুক্তির ছোঁয়া আনতে হবে। আমাদের এখানে অনেক আগেই অনেক এলাকা থেকে লাঙল ও গরু দিয়ে চাষ করা প্রায় উঠে গেছে। কৃষিতে আমেরিকান স্টাইল আনা জরুরি। যেখানে সব কাজ যন্ত্রচালিত হবে। এতে শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিতে ঝুঁকবে।
তবে ড. মনসুর বলেন, সব মিলিয়ে করোনা অর্থনীতিসহ মানুষের মনোজগতেও যে আঘাত দিয়েছে, সেখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী যেসব লোক কাজ হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন, তাদের নগদ অর্থ-সহায়তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। রাস্তাঘাট সংস্কার শুরু করে গ্রামে সরকারি কাজ বাড়াতে হবে। এতে সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। আর সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে আসতে হলে কলকারখানাসহ সব প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সচল রাখতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেটা সচল রাখাও চ্যালেঞ্জ। তবে অর্থনীতি আগের জায়গায় নিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। এটা করা গেলে কাজ হারানো লোকগুলো আবার কাজ ফেরত পাবেন।
তিনি বলেন, করোনাকালে সরকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। এই প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে কারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবার সচল হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর'বি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে দেওয়া লকডাউনের কারণে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন কমে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে অস্থিতিশীল মনে করছেন ৯১ শতাংশ মানুষ।
এছাড়া করোনাকালে সমতলের আদিবাসীদের জীবনযাপন নিয়ে একটি জরিপ করে ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (আইপিডিএস)। তাদের সহায়তা করেছে ইউরোপের মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ (এমআরজি-ইউরোপ)। তাদের জরিপে উঠে আসে, করোনায় সমতলের ৯২ শতাংশ আদিবাসীর আয়-রোজগার কমে গেছে। ৭২ শতাংশ চাকরি হারিয়েছে। এতে অন্তত ৫ লাখ আদিবাসী 'নতুন দরিদ্রে' পরিণত হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনাকালে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা এবং যোগাযোগ খরচ বহন করতে না পেরে তারা ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চিত্রও প্রায় অভিন্ন। করোনাকালে কাজ হারিয়ে চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র চলে গেছে ৯ শতাংশ মানুষ।
ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া আবদুল্লাহ নুহু আপাতত কুষ্টিয়ার মিরপুরে উঠেছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে, যদিও তার গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়। কুষ্টিয়ায় তার দুই মাস পার হলেও এখনও কোনো কাজ পাননি। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। জীবিকার জন্য নিরুপায় নুহু চেষ্টা করছেন একটি ইউটিউব চ্যানেল দাঁড় করাতে। এ জন্য তিনি ব্যতিক্রমী কিছু গল্প দিয়ে ভিডিও নির্মাণ করছেন গ্রামে বসেই। তাতেও সুবিধা করতে পারছেন না। এখন আবার এলাকায় একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। তবে হাতে নগদ টাকা না থাকায় দোকান দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। নুহু বলেন, 'কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছি না। কী করব, কীভাবে চলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।'
নুহুর মতো বহু মানুষ যে ঢাকা ছেড়েছে, তার একটা বড় প্রমাণ রাজধানীতে টু-লেটের ছড়াছড়ি। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ঘুরলে দেখা যায়, অধিকাংশ বাড়িতে ঝুলছে টু-লেট লেখা বোর্ড। অনেকেই বাসা ছেড়ে দেওয়ায় ভাড়াটিয়া সংকটে পড়েছেন অধিকাংশ বাড়ির মালিক। ঢাকায় ভাড়াটিয়া নিয়ে এমন সংকট নিকট অতীতে দেখা যায়নি।
ঢাকার বাসা ছেড়ে দেওয়া হাজার হাজার মানুষের একজন বিচিত্র মণ্ডল। তার বাড়ি খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা গ্রামে। ১০ বছর ধরে ঢাকায় ছিলেন। সর্বশেষ চাকরি করছিলেন তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। করোনার মহাসংকটে গত এপ্রিলে সস্ত্রীক গ্রামে চলে যান। এর কিছুদিন পরই চাকরি চলে যায় তার। পরে ঢাকার মায়া আর রামপুরার বাসা ছেড়ে আসবাব নিয়ে গ্রামে পাড়ি জমান তিনি।
৩২ বছর বয়সী বিচিত্র মণ্ডল সমকালকে বলেন, 'চাকরি নেই। ঘর ভাড়া, সংসার খরচ জোগাড় করব কীভাবে? তাই একেবারেই চলে এলাম গ্রামে। গ্রামেও কোনো কাজ নেই। কী করব বুঝতে পারছি না। বাবার খুব বেশি জমিও নেই যে চাষাবাদ করে জীবন চলবে। আয়ের পথ খুঁজতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।'
তিলডাঙ্গা গ্রামের উত্তম মণ্ডলও করোনাকালে চাকরি হারিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। এখনও এলাকায় কোনো কর্মসংস্থান হয়নি তার। তিনি এখন কী করবেন, তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এলাকায় কর্মসংস্থান না হলে আবার ঢাকায় ফেরার কথা ভাববেন। তবে ঢাকায় ফিরে যে চাকরি পাবেন, সে নিশ্চয়তাও নেই বলে জানান তিনি।
তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রণজিৎ কুমার মণ্ডল সমকালকে বলেন, করোনাকালে তার ইউনিয়নের অন্তত ২০০ বাসিন্দা ঢাকা এবং গাজীপুর থেকে গ্রামে ফিরেছে। তাদের বেশিরভাগই কর্মচারী পর্যায়ের।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকার বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক যাত্রাবাড়ীতে একটি হোটেলের কর্মচারী ছিলেন। করোনার কারণে হোটেল বন্ধ হয়ে গেলে এপ্রিলে রাজ্জাক তার স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যান। রাজ্জাক সমকালকে বলেন, যাত্রাবাড়ীর হোটেলে যা বেতন পেতেন তা সংসার চালাতেই শেষ হয়ে যেত। জমা কোনো টাকা নেই। খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। সেখানে এখনও কোনো কর্মসংস্থান হয়নি তার।
ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার বাসিন্দা আবু জাফর উত্তরায় একটি বায়িং হাউসে চাকরি করতেন। করোনা আতঙ্কে তিনি নিজেই চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান গত এপ্রিলে। ঝিনাইদহ শহরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ঘুরেছেন, লাভ হয়নি। আবু জাফর সমকালকে বলেন, ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা নেই আর। ঝিনাইনদহ শহরে চাকরি খুঁজছেন। করোনার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানেই তেমন নিয়োগ হচ্ছে না।
ষাটোর্ধ্ব ফরিদুল ইসলাম এক দশকের বেশি সময় ধরে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ফুটপাতে চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন হাতিরঝিলসংলগ্ন টিনের ছাপড়া ঘরে। করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর গত এপ্রিলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা ছাড়েন ফরিদুল। এখনও অবস্থান করছেন গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি বলেন, আর ঢাকায় ফিরবেন না। কারণ বাসা ভাড়াসহ সংসারের খরচ জোগাতে যে টাকা দরকার হয় তা আবার রোজগার করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তাই আবার ঢাকায় এসে নতুন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে চান না তিনি। গ্রামে এখনও কাজ জোগাড় করতে পারেননি তিনি, তবে একটা কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।




বিষয় : জীবিকার সংকট গ্রামেও

মন্তব্য করুন