নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে ভারসাম্য থাকে

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলে ঢাকা সফররত মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলকে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে এক ধরনের ভারসাম্য থাকে বলেও মনে করেন তিনি। তবে মার্কিন পর্যবেক্ষক দল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে বৈঠক শেষে সিইসি সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত মার্কিন মিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ এবং একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, নারী এমপি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আজ বুধবার সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বৈঠকের কথা রয়েছে। এর আগে এনডিআই ও আইআরআই যৌথ প্রেস বিবৃতিতে বলেছিল, তাদের কার্যক্রম শেষ করে প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশের বিশ্লেষণ এবং অন্যান্য বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হবে।
কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে প্রতিনিধি দল নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চায়। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিইসি ও অন্য কমিশনাররা। তারা নির্বাচনকালে ইসির আইনি ক্ষমতার বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ভোট গ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি না থাকলে প্রিসাইডিং অফিসারদের তা বন্ধের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভোট গণনা হয় প্রার্থী বা তাদের নিযুক্ত পোলিং এজেন্টদের সামনে।
মার্কিন পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা কীভাবে বজায় রাখা হয়, তাও জানতে চেয়েছে জানিয়ে সিইসি বলেন, তারা নির্বাচনকালীন ইসি ও সরকারের ভূমিকা জানতে চেয়েছেন। নির্বাচনের সময় সরকারের সঙ্গে ইসি কীভাবে সমন্বয় করে, তাও জানতে চান। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও জানান তিনি। তবে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের কোনো সদস্য গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি।
সিইসি বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল হয়তো দেশে ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা।
জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ চান গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা
জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার তাগিদ দিয়েছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক বৈঠকে তারা বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে দু’পক্ষের অবস্থান আলাদা। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে দু’পক্ষকেই আলোচনায় বসতে হবে।
গতকাল রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে তারা এ মতামত তুলে ধরেন। দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধি দলের পক্ষে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে অংশ নেন ঢাকা ট্রিবিউনের প্রধান সম্পাদক জাফর সোবহান, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান। অন্যদিকে মার্কিন পর্যবেক্ষক দলে ছিলেন রিক ইনডারফার্ত, মারিয়া চিন আবদুল্লা, মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেস সাক্স স্পাইকারম্যান, আকাশ কুল্লুরি, বোনি গ্লিক, জামিল জাফের, জো কাও প্রমুখ।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জাফর সোবহান বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিরা কিছু জানতে চাননি। তবে তারা বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন চান, এটি বলেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন চান– সেটা কীভাবে হতে পারে, সে জন্য রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তারা বসেছেন বলে জানিয়েছেন।
মিডিয়ার সঙ্গেও কিছু কথা বলতে চেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের ধারণা জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, আমরাও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমরা সবাই স্বাধীনতা চাচ্ছি ভালোভাবে রিপোর্ট প্রকাশের।’ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো বাধার কথা বলেছেন কিনা এমন প্রশ্নে জাফর সোবহান বলেন, ‘বাধা রয়েছে এমন কিছু আমরা তাদের বলিনি।’ জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতি প্রসঙ্গে আপনারা কোনো প্রস্তাব দিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, দুই দলকে বসতে হবে, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল একসঙ্গে বসবে। নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য হলে সবার জন্যই ভালো হবে।’
এ সময় সোহরাব হাসান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। তবে নির্বাচনের কী পরিবেশের কথা জানানো হয়েছে, তা উল্লেখ করেননি তিনি। সোহরাব হাসান বলেন, ‘আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচনের কথাও বলা হয়েছে। আমরা মাঠে যা দেখছি, যা শুনছি, তা বলার চেষ্টার করেছি। যে বাধা আছে, তা অতিক্রম করার চেষ্টা আছে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের।’
মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে কোনো পক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এখানে মিডিয়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আলোচনা হয়েছে প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে।
নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা নারী এমপিদের
গণমাধ্যম প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে নারী সংসদ সদস্যদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। এতে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সেলিমা আহমাদ, জাতীয় পার্টির শেরীফা কাদের ও নাজমা আক্তার, জাসদের আফরোজা হক রীনা ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মনি। বৈঠকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা প্রকাশ করেছে নারী প্রতিনিধি দল।
বৈঠক শেষে সেলিমা আহমাদ সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে নির্বাচন কতটা নারী সহায়ক এবং সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ নিজেদেরই করতে হবে। বিদেশিরা করে দেবে না– এটা তিনি বৈঠকে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে কিনা বৈঠকে এমন প্রশ্ন এসেছে। প্রতিটি নির্বাচনে কমবেশি সহিংসতা হয়– এ কথা তারা উল্লেখ করেছেন। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচন পদ্ধতি প্রসঙ্গে সেলিমা আহমাদ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।
নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে বৈঠকে আফরোজা হক রীনা বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা সহিংসতা প্রতিরোধ করতে চায় কিনা। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঠিকভাবে কাজ করলে সহিংসতা হবে না; সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধান মেনেই হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
নিলুফার চৌধুরী মনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা হবে কিনা সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। পর্যবেক্ষক দল নিজেরাও সহিংসতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। বৈঠকে মতামত দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, এ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নারীদের ভোটকেন্দ্র যাওয়ার আগেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক
সন্ধ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন পর্যবেক্ষক দল। এতে অংশ নেন ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নিমচন্দ্র ভৌমিক, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের (বি-স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব, ইনক্লুসিভ পলিসি অ্যাডভোকেসির সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আহমেদ প্রমুখ।
বৈঠক শেষে শারমিন মুরশিদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে কোথায় বাধা রয়েছে এবং সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরিবেশ নিয় শঙ্কা রয়েছে কিনা– এ বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে আমাদের নির্বাচন সহিংসতার দিকে এগিয়ে গেছে এবং দলীয় সংকট খুব বড়ভাবে দেখা গেছে। ক্ষমতার লড়াই থেকে দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর কিছু অত্যাচার হয়ে যায়। যে গোষ্ঠীর একটি বিশেষ ভোটব্যাংক, তাদের অন্য দলের লোকেরা সংকুচিত করতে চায়। এটি কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়; বরং এটি হলো ক্ষমতায় শক্তিশালী হওয়ার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য করা হয়। এটিই বৈঠকে বলা হয়েছে।
এর আগে আইনজীবী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। বিএনপিপন্থি ব্যারিস্টার সৈয়দ এজাজ কবির ও অন্য এক আইনজীবী এতে অংশ নেন। তবে তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।