পূর্ণতা পেল পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধন শেষে মাওয়া রেলস্টেশন থেকে টিকিট কেটে ট্রেনে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানাসহ পরিবারের সদস্যরা -মাহবুব হোসেন নবীন
ফরিদপুর অফিস ও মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে পূর্ণতা পেল পদ্মা সেতু। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ ট্রেনে চড়ে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া স্টেশন থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছেন। এর আগে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পদ্মা নদী রেলে করে পাড়ি দেওয়া– আজকের দিন সেই স্বপ্ন পূরণের দিন।
মাওয়া স্টেশন চত্বরে উদ্বোধন শেষে দুপুর ১২টা ৫২ মিনিটে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে টিকিট কাউন্টারে যান প্রধানমন্ত্রী। এক নম্বর কাউন্টার থেকে বুকিং সহকারী সীমা মিস্ত্রির কাছ থেকে টিকিট নেন সরকারপ্রধান। পাশের কাউন্টারে আরেক বুকিং সহকারী নূরজাহান বেগমের কাছ থেকে টিকিট কাটেন শেখ রেহানা। এ সময় তাঁর তিন নাতি-নাতনিও টিকিট নেয়।
রেলপথে মাওয়া থেকে ভাঙ্গার দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার হলেও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩১ কিলোমিটার দূরত্ব ধরে। এই পথে এসি সিট শ্রেণিতে ভাড়া ৪৪৯ টাকা। প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি টিকিটের জন্য ২ হাজার ২৪৫ টাকা পরিশোধ করেন। বিশেষ ট্রেনে মন্ত্রিসভার সদস্য, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক, কূটনীতিক ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ১১ জন সরকারপ্রধানের সহযাত্রী হন। তারা সবাই সৌজন্য টিকিটে ট্রেনে চড়েন।
ট্রেনের আসনে বসে প্রধানমন্ত্রীকে মোনাজাত করতে দেখা যায়। পদ্মার ওপর দিয়ে ট্রেন চলার সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখা যায়। পুরো যাত্রায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর চলেছে পদ্মা সেতুর ওপরের সড়ক দিয়ে। এ ছাড়া আকাশে ছিল র্যাবের হেলিকপ্টারের টহল।
দুপুর ১২টা ৫৯ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেনটি মাওয়া স্টেশন থেকে যাত্রা করে। প্রথম নারী স্টেশন মাস্টার হিসেবে ট্রেন যাত্রার সংকেত দেন সালেহা পারভীন। ১৪ বগির এই ট্রেনটির দুই পাশে ছিল দুটি ইঞ্জিন। পদ্মা সেতুতে দুপুর ১টা ৭ মিনিটে ট্রেনটি ওঠে। আট মিনিটে সেতু পার হয়। ১২টা ৫৯ মিনিটে তাঁকে বহনকারী ট্রেনটি ফরিদপুরের ভাঙ্গার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। ১টা ৫৫ মিনিটে ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী।
চীনের ঋণে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইন নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায়। রাজধানীর কমলাপুর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এই রেলপথের সাড়ে ৮২ কিলোমিটার গতকাল উদ্বোধন হয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর জুনে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলবে।
গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধনের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল পদ্মা সেতুর ওপর তলায় গাড়ি চলছে। সাড়ে ১৫ মাস পর নিচতলায় শুরু হলো ট্রেন চলাচল। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ট্রেন চলাচলে পূর্ণতা পেল পদ্মা সেতু। করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বাধা অতিক্রম করে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।
আগামী মাসে কমলাপুর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে পদ্মা সেতু হয়ে। ঢাকার কমলাপুর থেকে খুলনা, যশোর, রাজশাহী যাবে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর জানান, আগামী জুনে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ শেষে পদ্মা সেতুতে দিনে আট জোড়া ট্রেন চলবে। তা থেকে বছরে ২৬৮ কোটি টাকা আয় হবে। চলবে তিন জোড়া পণ্যবাহী ট্রেন। তা থেকে আয় হবে ১০৫ কোটি টাকা। তিন ঘণ্টায় যশোর এবং সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনা যাবে ট্রেন।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ট্রেনে রাজধানীর কাছাকাছি এসেছে দক্ষিণবঙ্গ। রেলপথে ঢাকা-খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। ঢাকা-যশোর রুটের দূরত্ব ৩৫২ কিলোমিটার থেকে কমে হবে ১৬৯ কিলোমিটার। বর্তমানে ঢাকা থেকে টঙ্গী, জয়দেবপুর, বঙ্গবন্ধু সেতু, ঈশ্বরদী, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ঘুরে দক্ষিণবঙ্গে যায় ট্রেন। আগামী নভেম্বর থেকে গেণ্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান, শ্রীনগর, মাওয়া, পদ্মা সেতু, ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে রাজবাড়ী দিয়ে গন্তব্যে যাবে।
ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথের ২৩ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার নির্মাণ করা হয়েছে ভায়াডাক্টের ওপরে। এটিই দেশের প্রথম উড়াল রেলপথ। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর এবং শরীয়তপুর জেলা রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে। আগামীতে যুক্ত হবে নড়াইলও।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে ডিজিটালি ফলক উন্মোচন করেন। তিনি বলেন, স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট আমাদের লক্ষ্য। বাঙালি জাতির ভাগ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না। এই দেশ আমাদের, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। কাজেই জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে বিশ্বে এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
সরকারপ্রধান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আছে বলেই এ দেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। আর যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের ধুয়া তোলে, তারা কখনও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। তারা ভোট চুরি করা ছাড়া কোনোদিন ক্ষমতায় আসেনি। যে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় জোট মাত্র ২৯ আসন পেয়েছিল।
পদ্মা সেতু নির্মাণে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে বলেন, সামান্য একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে পারবে না বয়সের কারণে, সেটা বলার জন্য বিশ্বব্যাংক তাঁর পক্ষে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। এর পরই ঘোষণা দিয়েছিলাম, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। আজকে তা করে দেখিয়েছি। আবারও প্রমাণ করেছি, বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের লক্ষ্য দেশকে আরও উন্নত করা।
উদ্বোধন অসুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন স্থানীয় এমপি সাগুফতা ইয়াসমিন, সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। মঞ্চে ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান ও প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন।
- বিষয় :
- পূর্ণতা পেল পদ্মা সেতু