উচ্চ খেলাপি ঋণ, আমানত কম পাওয়া, ঋণ চাহিদা কম থাকাসহ নানা কারণে করোনার আগেই সংকটে ছিল ব্যাংক খাত। এর মধ্যে এ বছরের শুরুতে ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নের নির্দেশনার পর ব্যাপক চাপে পড়ে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ হলে সেই চাপ আরও বেড়ে গেছে। তবে এই খারাপ অবস্থার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতে শক্তি জোগাচ্ছে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ। ভর্তুকি সুদে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের উদ্যোগ এবং এর সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাতে কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। প্রণোদনার ঋণের পাশাপাশি নানা নীতি-সহায়তার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। তবে প্রণোদনার ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে তৎপর থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাংকাররা জানান, বাংলাদেশে করোনার প্রভাব শুরুর আগে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে অধিকাংশ ব্যাংকে আমানত সংকট ছিল। ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদের আমানত পেতে মরিয়া ছিলেন ব্যাংকাররা। এসব ব্যাংক এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে না। এখন সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়েছে। এই উদ্বৃত্ত তারল্যের অন্যতম কারণ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-সহায়তা এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রণোদনার আওতায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন করছে। এর পরও কোনো ব্যাংক যেন সংকটে না পড়ে সে জন্য সিআরআর বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার হার দেড় শতাংশ কমিয়ে দেওয়ায় ব্যাংকগুলোতে ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণযোগ্য তহবিল তৈরি হয়েছে। আবার আমদানি ব্যয় কমলেও প্রচুর রেমিট্যান্সের কারণে গত আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ ৬৩৬ কোটি ডলার সরকারের দুই শতাংশ হারে ভর্তুকি রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। বাড়তি তারল্যের আলোকে ঋণ দিতে গিয়ে কোনো ব্যাংক যেন সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য সব ব্যাংকের ২ শতাংশ করে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ ব্যাংক খাতের জন্য শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখন ব্যবসা আনা এবং বিতরণ করা ঋণ যেন সঠিক খাতে ব্যবহার হয়, ব্যাংকারদের তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন এবং নীতি-সহায়তার কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানত বাবদ খরচ কমেছে। এতে তারল্য নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন স্বস্তিতে আছে। তবে এসএমই খাতের তহবিল ব্যবস্থাপনায় এখনও ৯ থেকে ১০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। অথচ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হচ্ছে। আবার আমদানিসহ ট্রেডিং এখনও সেভাবে বাড়েনি। যে কারণে ব্যাংকগুলোর নন-ফান্ডেড ব্যবসা আগের পর্যায়ে আসেনি। সব মিলিয়ে এবারে ব্যাংকগুলো কতটা মুনাফা করতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
জানা গেছে, কৃষক, ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ প্রণোদনা প্যাকেজের সব ঋণ আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিতরণ শেষ করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো এখন এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে। অবশ্য করোনা সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার যে এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার পুরোটাই অনুদান নয়। এর মধ্যে ৮৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে ভর্তুকি সুদে ঋণ আকারে। আর সামাজিক সুরক্ষা, অতি দরিদ্রদের এককালীন অনুদানসহ নানা উপায়ে দেওয়া হয়েছে বাকি অর্থ। প্রণোদনার আওতায় কোন খাতে কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হবে, তা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য দেওয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং সব গ্রাহকের এপ্রিল ও মে মাসের স্থগিত সুদের আংশিক ভর্তুকির জন্য দুই হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে বিতরণ শেষ হয়েছে। আর ভর্তুকি সুদে শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৩৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বেতন-ভাতা হিসেবে পাঁচ হাজার কোটি টাকাসহ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া সিএমএসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪২শ' কোটি টাকা, কৃষি খাতের পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১১শ' কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিটের পাঁচ হাজার কোটি টাকার এক কোটি ১১ লাখ টাকা এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) নতুন করে যুক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া সমকালকে বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা বাস্তবায়নই এখন ব্যাংকগুলোর মূল কাজ। প্রণোদনার আওতায় কৃষি ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৫ শতাংশ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ঋণ বিতরণের কাজ চলছে। তিনি বলেন, যে কোনো ঋণ বিতরণ করে তা আদায়ে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ থাকে। এ ক্ষেত্রেও আছে। তবে যেহেতু সব ধরনের নিয়ম মেনে এসব ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, ব্যাংকগুলো দেখেশুনে ঋণ দিচ্ছে, ঋণ আদায়ের দায়িত্বও আমাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। করোনার প্রভাব শুরুর মাস মার্চ শেষে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত তারল্য আরও বেড়েছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর গড় ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মানে বেশিরভাগ ব্যাংকের হাতে এখন প্রচুর ঋণযোগ্য তহবিল রয়েছে।