তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চালক ছিলেন আবদুল মালেক। কিন্তু কীভাবে তিনি এত বিত্তের মালিক হলেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটই মূলত মালেকের 'কারিগর'। তারাই চালক মালেককে গড়ে তোলেন। আর তাদের হাত ধরেই শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। মালেকের সুপারিশে স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এসব কর্মকর্তাই বদলি, পদোন্নতি ও নিয়োগ দিতেন। তার সুপারিশে অনেকে কোটি কোটি টাকার কাজও পেয়েছেন। র‌্যাবের হাতে মালেক গ্রেপ্তারের পর তার 'কারিগর'রাও রেহাই পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে বড় বড় পদে থেকে যারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন, তাদের ব্যাপারে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান। পদে চুনোপুঁটি হয়েও যারা অর্থবিত্তের পাহাড় গড়েছেন, তাদের পাশাপাশি বড় পদে থাকা দুর্নীতিবাজদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এমন আভাস মিলেছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেককে রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১-এর একটি দল। তবে গ্রেপ্তারের পরও তার অপকর্ম আর সম্পদের অনুসন্ধান চালাতে থাকেন গোয়েন্দারা। ওই তদন্তে সামান্য গাড়িচালক মালেকের এখন পর্যন্ত একশ' কোটি টাকার বেশি সম্পদের খোঁজ মিলেছে। বর্তমানে অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় করা পৃথক দুই মামলায় মালেককে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তুরাগ থানা পুলিশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দু-এক দিনের মধ্যে এ মামলার তদন্তভার র‌্যাবের কাছে ন্যস্ত হচ্ছে।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মালেকের দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে তার সম্পদের বিস্তর ফারাক। পরিবারের নামেও অনেক সম্পদ গড়েছেন তিনি। তদন্তের শুরুতে বেরিয়ে আসে, তার সম্পদের পরিমাণ একশ' কোটি টাকার বেশি। তবে এখন তার আরও কিছু সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। ঢাকায় মালেক ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে আরও অনেক প্লটের খোঁজ মিলেছে। শিগগিরই মালেকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। এরপর তার অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এর আগে কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছিলেন অনেকে। সিআইডির তদন্তের পর অনেক মাদক কারবারির বাড়ি আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়। একই আদলে মালেকের বাড়ি-গাড়িও জব্দ হতে পারে। এ ছাড়া মালেকের কাছ থেকে জব্দ অস্ত্রের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য গতকাল সেটি সিআইডিতে পাঠিয়েছে তুরাগ থানা পুলিশ।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে মালেক তার সম্পদের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না। নথিপত্র দেখিয়ে জানতে চাইলে শুধু 'হ্যাঁ' সূচক জবাব দিচ্ছেন।
একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে তার সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন মালেক। কে কোথায় গাড়ি চালাবেন, তার অনেক কিছু মালেক নিয়ন্ত্রণ করতেন। মালেকের ব্যাপারে একাধিক দায়িত্বশীল সংস্থার তদন্তেও উঠে আসে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সব ড্রাইভারের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল মালেকের। ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে তিনি বিপুল অর্থ কামিয়েছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতিতে নিয়ন্ত্রণ ছিল মালেকের। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ থেকেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, মালেকের প্রথম স্ত্রী নার্গিস বেগম। দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি করেন। প্রথম ঘরে তার চার সন্তান। তাদের মধ্যে তিন মেয়ে হলেন বেবী, বেলি ও মিলি। আর ছেলে ইমন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। অবৈধ সম্পদ যা গড়েছেন, তা মালেক শুধু নিজের নামে করেননি, পরিবারের সদস্যদের নামেও করেছেন। প্রথম স্ত্রীর নামে তুরাগের কামারপাড়ায় সাততলাবিশিষ্ট দুটি ভবন রয়েছে। তুরাগে মালেকের নামে আছে আরও দুটি প্লট ও স্ত্রী নার্গিসের নামে দুটি। বড় মেয়ে বেবীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমির ওপর রয়েছে ডেইরি ফার্ম। ২৩ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ১০তলা ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। তবে ওই ভবন নিয়ে মালেকের সঙ্গে তার ভাই আবদুল খালেকের বিরোধ চলছে। মামলা থাকায় আপাতত ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ আছে।
মালেকের প্রথম স্ত্রী নার্গিস বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্রের নথি বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, সেখানে তার পেশা 'গৃহিণী'। পিতা আবদুল জব্বার শিকারি। বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে বি-১০, এজিবি কলোনি, মতিঝিল। স্থায়ী ঠিকানা ২৩ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল। প্রশ্ন উঠেছে, যার পেশা গৃহিণী, স্বামী গাড়িচালক, শ্বশুর চতুর্থ শ্রেণির সাবেক কর্মচারী, তার নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এলো কীভাবে? স্বামীর অবৈধ আয়ের মাধ্যমে বিত্তের এই পাহাড় গড়েন নার্গিস। এ ব্যাপারে জানতে ফোন করা হলে নার্গিসের একটি নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। আরেকটি নম্বরে রিং বাজলেও তা রিসিভ করেননি। তবে তুরাগের বাড়িতে গেলে ঘরের ভেতর থেকে তার মেয়ে বলেন, 'পত্রিকায় যে সম্পদ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, তা তাদের পৈতৃক।'
মালেক ১৯৮২ সালে সাভারে একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে তার চাকরি স্থায়ী হয়। এরপর তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে গাড়িচালক হিসেবে বদলি হন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত কাগজে-কলমে সেখানেই তিনি গাড়িচালক ছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মনিরের আমলে মূলত তার উত্থান। নানা সময় বিভিন্ন ডিজির গাড়ি চালাতেন। সর্বশেষ চালিয়েছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েতের গাড়ি। এরপর একে একে পরিবারের অনেক সদস্যকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি দেন মালেক। তার দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন রয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইব্রেরিতে বুক শর্টার পদে। মেয়ে নওরিন সুলতানা বেলি রয়েছেন অফিস সহকারী, ভাই আবদুল খালেক অফিস সহায়ক, ভাতিজা আবদুল হাকিম একই পদে, বড় মেয়ে বেবীর স্বামী রতন ক্যান্টিন ম্যানেজার, ভাগ্নে সোহেল শিকারি ড্রাইভার পদে, ভায়রা মাহবুব একই পদে, আরেক আত্মীয় কামাল পাশা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহায়ক পদে কর্মরত।
তদন্ত সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যে মালেক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা সবচেয়ে বেশি অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, তাদের মধ্যে চারজন রয়েছেন শীর্ষে। তারা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ফকির, সৈয়দ জালাল ও জাহাঙ্গীর আলম। মালেকের দুর্নীতিচক্রে তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এ ছাড়া মালেকের দুষ্টচক্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক তিন মহাপরিচালক, বিএমএর একজন শীর্ষ নেতা ও স্বাচিপের দু'জন নেতার সংশ্নিষ্টতা ছিল।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মালেক সিন্ডিকেট কোনো কাজ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের টোপ দিতেন। কেউ তার প্রস্তাবে রাজি না হলে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় দুর্নীতির রিপোর্ট ছাপানোর হুমকি দিতেন।
অপর একটি সূত্র জানায়, চাকরিতে যোগদানের সময় জমা দেওয়া মালেকের ব্যক্তিগত নথি খতিয়ে দেখা হবে। কারণ, এরই মধ্যে তার বয়স নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মালেকের জন্ম ১৯৬২ সালের ১০ জানুয়ারি। তবে গোয়েন্দাদের কাছে ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মালেকের জন্ম-সংক্রান্ত যে নথি রয়েছে, তার মধ্যে বয়সের তারতম্য রয়েছে। ভুয়া জন্মসনদ নেওয়া হলে মালেকের বিরুদ্ধে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, মালেক গ্রেপ্তারের পরপরই তার দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ভোল পাল্টেছেন। তিনি সহকর্মীদের কাছে দাবি করছেন, মালেককে কখনও বিয়ে করেননি। হঠাৎ রাবেয়ার এমন আচরণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেকের কাছে তা নতুন আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছে।


বিষয় : মালেকের 'কারিগর'রাও রেহাই পাবে না

মন্তব্য করুন