জাল দলিলে বেচাকেনা হচ্ছে বন বিভাগের সরকারি জমি। জমির দখল নিতে রাতারাতি ঘরও তুলছে দখলদাররা। অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সেই ঘরে আবার রাতারাতি লাগানো হচ্ছে বিদ্যুতের মিটার। সরকারি জায়গা ভোগদখল করতে এমন একটি চক্র গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। বন বিভাগ ও পিডিবির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় একের পর এক অপকর্ম করছে এই চক্র। পরস্পর যোগসাজশে এই চক্র জাল দলিলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ নিশ্চিন্তপুর গ্রামে দখল করেছে বন বিভাগের প্রায় ৩২০ শতক জমি।
সামাজিক বনায়নের আওতায় ১৫ বছর আগে এসব জমি স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুব আলম ও তার ছেলে আরিফ বখতিয়ারকে চুক্তিমূলে লিজ দেয় বন বিভাগ। লিজ পাওয়ার পর তারা আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, গামারি, চাপালিশসহ বিভিন্ন জাতের সহস্রাধিক গাছ লাগান। এসব গাছের কোনোটির বয়স এখন ১০ বছর; কোনোটির ১৫ বছর। কিন্তু গাছসহ কোটি টাকার এই জায়গা দখল করতে প্রথমে জাল দলিল সৃজন করে মোহাম্মদ হাবিব, মোহাম্মদ ফোরকানসহ কয়েকজন দখলদার। এরপর সেই দলিল দেখিয়ে রাতারাতি নিয়ে এসেছে তারা বিদ্যুতের মিটারও! এ জন্য দখলদাররা ঘরের ছাউনি, খুঁটিসহ আনুষঙ্গিক সব অংশ অন্যত্র প্রস্তুত করে রাখে। এসব নিয়ে ২০ থেকে ৩০ জনের একটি দল ২৮ আগস্ট মধ্য রাতেই বন বিভাগের জায়গায় এসে স্থাপন করে একটি ঘর। আগে থেকে ম্যানেজ হয়ে থাকা পিডিবি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই ঘরে লাগিয়ে দেয় মিটারও।
দখলদাররা বলছে, লিজ পাওয়া ব্যক্তি থেকে তারা এটি দলিলমূলে কিনে নিয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী বন বিভাগের সরকারি কোনো জমি দলিলমূলে কেউ বেঁচাকেনা করতে পারে না। আবার আসল দলিল ছাড়া বিদ্যুতের মিটারও লাগাতে পারে না পিডিবি। তারপরও সব অসম্ভব সম্ভব হয়েছে নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। এই অনিয়মের বিচার চেয়ে লিজ পাওয়া মাহবুব আলম বিষয়টি জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ (আইজি) সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। এই অভিযোগে দখলদার হিসেবে মোহাম্মদ হাবিব, মোহাম্মদ ফোরকানের নাম উল্লেখ করে বেশ কয়েকজন জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আছে কোদালা বন ও বিট ইনচার্জ হারুনের নামও।
জানতে চাইলে মাহবুব আলম বলেন, '২০০৬ সালের ১ জুলাই বন বিভাগ থেকে এই জমি চুক্তিমূলে বরাদ্দ নিই আমি ও আমার ছেলে। বরাদ্দ নেওয়ার পর আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকেল, গামারি, জলপাই, চাপালিশসহ বিভিন্ন জাতের সহস্রাধিক গাছ লাগাই। কিন্তু আমার স্বাক্ষর জাল করে সামাজিক বনায়নের জন্য চুক্তি নেওয়া জায়গা জোরপূর্বক দখলে নিয়ে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগও দেওয়া হয়েছে। অথচ আমি কারও কাছে জমি বিক্রি করিনি। হস্তান্তরও করিনি। হাবিব, ফোরকানসহ দখলদার এই চক্রের বিরুদ্ধে জাল দলিল তৈরি করে সরকারি জায়গা দখলের এমন আরও অভিযোগ আছে রাঙ্গুনিয়ায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হয়েছে।'
জমি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ হাবিব বলেন, 'মাহবুব আলমের ছেলে কায়সার হামিদের কাছে আমরা কয়েকজন টাকা পাই। এটার বিনিময়ে সে আমাদের বন বিভাগের এই জায়গা ভোগদখল করতে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে দেয়। এই দলিলমূলে আমি পিডিবিতে মিটারের জন্য আবেদন করি। তারা এসে মিটার লাগিয়ে দেয়।' বন বিভাগের জমি এভাবে হাতবদল কিংবা জাল দলিল করার নিয়ম আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'রাঙ্গুনিয়ায় সরকারি অনেক জমি এভাবে ভোগদখল করছে অনেকে। যার কাছে যা দখল আছে, সেটি তারা ভোগদখল করে।' দখলস্বত্বে তিনিসহ চার-পাঁচজন এখন সরকারি এই জমির মালিক বলে দাবি করেন।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক বনায়নের জায়গার গাছ বিক্রির ৪৫ শতাংশ পাবে ভূমির চুক্তিকারী। ৪৫ শতাংশ বন বিভাগ ও ১০ শতাংশ যাবে ফার্মিং ফান্ডে। সামাজিক বনায়নের চুক্তি করা সরকারি জমি বিক্রির কোনো বিধান নেই বলে জানিয়েছেন বন বিভাগ চট্টগ্রামের সংরক্ষক আবদুল আউয়াল সরকার। তিনি বলেন, 'লভ্যাংশের ভিত্তিতেই চুক্তি করা হয়। কেউ স্থ্থানান্তর করলে কিংবা বেচাকেনা করলে অথবা অন্য কোনো জাল দলিল করলে তা বৈধ নয়। এটির অনুকূলে বিদ্যুতের মিটার লাগানো হলে সেটিও বৈধ নয়। রাঙ্গুনিয়ার ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগ পাইনি আমি। পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।'

বিষয় : জাল দলিলে জমি দখল

মন্তব্য করুন