৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ে পুলিশের সঙ্গে ব্যবসায়ীর বড় ভাই

ছবি: সংগৃহীত
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৩ | ১৬:২৮ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩ | ১৬:২৮
ছোট ভাইয়ের টাকা ছিনতাই করতে পুলিশ ভাড়া করেছিলেন বড় ভাই মোশারফ হোসেন। পূর্বপরিচিত গুলশান থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে ছিনতাইয়ের ছক আঁকেন। ১৫ দিন আগে সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। সোমবার ছিনতাইয়ের সফল অপারেশনের পর ওই টাকা ভাগ করে নেন। এএসআই দেলোয়ার রাজারবাগে তার ভগ্নিপতির বাসায় সেই টাকা লুকিয়ে রাখেন। জড়িত আরেক পুলিশ কনস্টেবল আবু সায়েম (অন্য ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত) তার ভাগের টাকা রাখেন রাজারবাগের ক্যান্টিন ব্যারাকে। এই তথ্য উঠে এসেছে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে।
পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত এএসআই দেলোয়ারের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা রয়েছে। ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানায় করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। আর পুলিশ সদস্য সায়েম অস্ত্র মামলার আসামি। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর পল্টন থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা হয়।
রাজধানীর দোলাইরপাড়ে ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত এ দুই পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজনের সম্পৃক্ততা মিলেছে। ছিনতাইকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন গুলশান থানা সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. দেলোয়ার হোসেন ও মোশারফ হোসেন। আবুল কালাম নামে যে ব্যবসায়ীর টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁর আপন বড় ভাই মোশারফ। তিনি এসআই দেলোয়ারের বাসার পাশে দীর্ঘদিন থাকতেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয়। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মোশারফের ব্যবসায়িক বিরোধ চলছিল। তাই তাকে ‘শায়েস্তা’ করার পরিকল্পনা করেন। এর পর এএসআই দেলোয়ারের ছক অনুযায়ী ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে এএসআই দেলোয়ার, কনস্টেবল আবু সায়েম, মোশারফ ও মাইক্রোবাসচালক আব্দুল বাতেন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের মধ্যে মোশারফ ও বাতেন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আর পুলিশের দুই সদস্যকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
গত সোমবার ঘটনার দিন সকাল ৯টার দিকে মোশারফ ফোন করে এএসআই দেলোয়ারকে জানান, শ্যামপুর দোলাইরপাড়ের সাবান ফ্যাক্টরির গলি থেকে তাঁর ভাই আবুল কালাম নাতি তানভীর হাসান নয়নের মাধ্যমে ৫৪ লাখ টাকা মতিঝিলে ব্যবসায়িক অংশীদার জাবেদুর রহমানের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে পাঠিয়েছেন। এর পর নয়ন দোলাইরপাড়ের ইউনিকেয়ার হাসপাতালের সামনে হেঁটে এলে অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তি তাঁর গতিরোধ করে। তাদের মধ্যে একজনের গায়ে ছিল লাল গেঞ্জি। নয়নকে একজন প্রশ্ন করেন, ‘তুই কি নয়ন। তুই কি কালামের নাতি।’ উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলার পর পরই নয়নকে জোর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে তারা। গাড়িতে উঠতে না চাইলে তারা পুলিশ বলে পরিচয় দেয়। এর পর টেনেহিঁচড়ে তাঁকে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। গাড়ি দোলাইরপাড় মোড় থেকে ইউটার্ন করে মাওয়াগামী রোডে প্রবেশ করে। মাইক্রোবাসের ভেতরে নয়নের কাছ থেকে সব টাকা ছিনিয়ে নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রসুলপুরে তাঁকে নামিয়ে দেয়।
এ ঘটনায় রাজধানীর শ্যামপুর মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ব্যবসায়ী আবুল কালাম। মামলার পর ডিবি পুলিশ ছায়াতদন্ত শুরু করে। সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি গাড়ির নম্বর শনাক্ত করে। এর পর প্রযুক্তির সহায়তায় চারজনকে শনাক্ত করা হয়। সোমবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ছিনতাইয়ের টাকার মধ্যে ১২ লাখ টাকা মোশারফের আলমারি থেকে উদ্ধার করা হয়। চালক বাতেনের কদমতলীর বাসায় পাওয়া যায় ৯ লাখ টাকা। আর ১২ লাখ টাকা মিলেছে এএসআই দেলোয়ারের ভগ্নিপতির বাসায়। সায়েম ভাগে পাওয়া ৮ লাখ ৮৭ হাজার পাওয়া গেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ক্যান্টিনের ব্যারাকে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মোশারফ জানান, ছোট ভাইয়ের ওপর ক্ষোভের বশবর্তী হয়েই তাঁর টাকা ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন। এএসআই দেলোয়ার একাধিক সময় তাঁর কাছে জানতে চান, মোটা টাকা কবে, কখন জমা দিতে যাবে কালামের লোকজন। ছোট ভাইয়ের টাকা ছিনতাইয়ে তাঁকে প্রলুব্ধ করেন এএসআই দেলোয়ার।
ছিনতাইকাণ্ডে দুই পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘অপরাধে জড়ালে কাউকে ছাড় নয়। আইন সবার জন্য সমান। ব্যক্তির দায় কেন পুলিশ বাহিনী নেবে? ছিনতাইয়ের ৪১ লাখ টাকা উদ্ধার করেছি। মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত আরও একজনকে খুঁজছি।’
শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ছিনতাই হওয়া ৫৪ লাখ টাকা হুন্ডির। ব্যবসায়ী দুই ভাই মোশারফ ও কালাম হুন্ডির সঙ্গে জড়িত। তবে টাকার উৎস খোঁজা আমাদের লক্ষ্য ছিল না। ছিনতাই হওয়ার পর টাকা উদ্ধারেই জোর দেওয়া হয়েছে।’