করোনা মহামারির কারণে নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনী উৎপাদন ও আমদানি কমেছে। তবে এ সময়ে এসব ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে। অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনার সাধারণ ছুটির পর গত চার মাসে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানে অবৈধ উৎপাদন হাতেনাতে ধরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থা। বিপুল পরিমাণ নকল পণ্য জব্দ করা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা ও জরিমানা করেছেন বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ অবস্থায় অবৈধ এ ব্যবসা বন্ধে কঠোর শাস্তির বিধান চায় কোম্পানিগুলো।
বিএসটিআই সূত্রে জানা যায়, যেসব নকল পণ্য বেশি ধরা পড়ে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো প্রসাধনী। করোনার সময়ে এ প্রবণতা বেড়েছে। গত বছরে ৫টি নকল পণ্যের কারখানায় অভিযান চালিয়ে প্রসাধনী জব্দ করে বিএসটিআই। এ বছরে এ পর্যন্ত ১৫টি কারখানায় নকল পণ্য জব্দ করেছে সংস্থাটি। বছরের শুরুতে তেমন নকল পণ্য ধরা পড়েনি। প্রায় তিন মাস সাধারণ ছুটি ছিল। মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সবাই যখন ঘরমুখো, তখন নকল পণ্য তৈরি বেড়ে যায়। মার্চ মাসে একটি নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানা খুঁজে পায় বিএসটিআই। তবে আগস্ট থেকে নভেম্বর ১৩টি নকল পণ্যের কারখানা সিলগালা করা হয়। চলতি বছরে মোট ১৫ প্রতিষ্ঠানে নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির প্রমাণ পায় বিএসটিআই। এসব কারখানা থেকে ৮ কোটি ৩০ লাখ টাকার নকল প্রসাধনী জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। পাশাপাশি ৬৬ লাখ টাকা জরিমানা ও ৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চলতি বছরে বিএসটিআই ছাড়া অন্যান্য সংস্থা আরও ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল প্রসাধনী ও ইলেকট্রনিক পণ্য জব্দ করে র‌্যাব। এনএসআই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে গত জুলাই মাসে রাজশাহীর পুঠিয়ায় মাসুদ রানার কারখানা থেকে কোটি টাকার নকল পণ্য জব্দ করে ধ্বংস করেছে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের লিগ্যাল ডিরেক্টর ও কোম্পানি সচিব এসওএম রাশেদুল কাইয়ুম সমকালকে বলেন, করোনাকালীন সাধারণ ছুটিতে মনিটরিং সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে তৎপর হয়েছে নকল পণ্য উৎপাদনকারীরা। নকল পণ্য উৎপাদন বন্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও পণ্য কিনতে সচেতন হতে হবে। কোম্পানির মোড়কের গায়ে বার কোড যাচাই করে কেনা উচিত। এতে ভোক্তারা নকল পণ্য থেকে রেহাই পাবেন। তিনি আরও বলেন, নকল পণ্য বন্ধ করতে আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়ানো প্রয়োজন।
স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণন বিভাগের প্রধান জেসমিন জামান সমকালকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নকল পণ্য বেড়েছে। সরকার ও প্রসাধনী পণ্যের প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এসব রোধে চেষ্টা করছে। তবে নকল বন্ধে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। ক্রেতাদের বার কোড চেক করে কেনা উচিত। দোকানিদের অতি মুনাফার লোভ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, নকল পণ্য উৎপাদন বন্ধে বর্তমান আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত।
শুধু প্রসাধনী নয়, নকল ও অবৈধভাবে বাজারে ছাড়া হচ্ছে ওষুধ, সিগারেট, মোবাইল হ্যান্ডসেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস, বৈদ্যুতিক হার, নকল রেভিনিউ স্ট্যাম্পসহ নানা পণ্য। এর ফলে সরকার প্রতি বছর বড় অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত ঠেকানো না গেলে তা একদিকে দেশের অর্থনীতিকে আরও ক্ষতির মুখে ফেলবে, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে। তাই সরকারকে নকল পণ্য উৎপাদন ঠেকাতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ অবস্থায় নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের শাস্তি বাড়াতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুম আরেফিন সমকালকে বলেন, নকল পণ্য রোধে ভোক্তাদের সবার আগে সচেতন হতে হবে। দেখে-শুনে ও বুঝে পণ্য কিনতে হবে। লোভনীয় অফারে পণ্য কেনার আগে যাচাই করতে হবে। এর পরও প্রতারিত হলে অধিদপ্তরে অভিযোগ করার আহ্বান জানান তিনি।
ব্যবহূত হচ্ছে ক্ষতিকারক কেমিক্যাল :নকল প্রসাধনী সামগ্রীতে সাধারণত ডাই ইথানল এমিন (ডিইএ), প্যারাবেন, সোডিয়াম সালফেট, পেট্রোলিয়াম জেলি, খনিজ তেল, বিউটিলেটেড গ্রাইকল, কৃত্রিম ফ্রাগ্রানেস, পলি ইথিলিন, হাইড্রক্সি এসিনল (বিএইচএ) এবং লোকটার ডাই ব্যবহূত হয়। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসব রাসায়নিক দিয়ে নকল প্রসাধনী তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাম, সয়াবিনসহ নানা তেলে রং ও সুগন্ধি দিয়ে তৈরি হচ্ছে দামি চুলের তেল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান সমকালকে বলেন, নকল প্রসাধনীর ক্ষতিকারক উপাদানে ত্বকে নানা রোগ ছড়ায়। ক্ষতিকারক কেমিক্যাল ব্যবহারে ত্বকে একজিমা ও অ্যালার্জি সমস্যা হবে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকে ক্যান্সার হতে পারে। তিনি বলেন, রং ফর্সা করার নকল ক্রিম ব্যবহারে চামড়া পাতলা হয়ে ও দ্রুত কুঁচকে যায়।
কিউআর কোডে তদারকি করবে বিএসটিআই :নকল প্রসাধনী রোধে কোম্পানিগুলোর কিউআর ও বার কোড বাস্তবায়ন জরুরি। পাশাপাশি এসব পণ্যের মান যাচাই করতে বিএসটিআইকে কিউআর কোড তদারকি করতে হবে। এ বিষয়ে বিএসটিআই উদ্যোগ নিয়েছে। বাজারে থাকা পণ্যে কিউআর কোড তদারকি করবে এ সংস্থা। এ জন্য পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন সরকার সমকালকে বলেন, কিউআর কোড তদারকি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এটি কার্যকর হলে নকল পণ্য থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, নকল রোধে সব সংস্থার সমন্বয় বাড়ানো দরকার। সবাই মিলে উদ্যোগ নিলে ভোক্তা সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রি রোধ করা যাবে। ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে প্রসাধনীর কিউআর-বার কোড নিশ্চিত করতে হবে। বিএসটিআই তা যাচাই করবে।





বিষয় : নকল প্রসাধনীর কারবার বেড়েছে করোনায়

মন্তব্য করুন