আমি কৈশোরেই যোগ দিয়েছিলাম ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের গানের দলে। দেশাত্মবোধক, সংগ্রামী ও মুক্তির গান গেয়েছি বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত ঘুরে ঘুরে। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের উজ্জীবিত করা। আমাদের গান ছিল মানবতার পক্ষে। গানের দলের নাম ছিল 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'। একদিন আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন তরুণ শিল্পীদের কাছে আসেন। তিনি আমাদের ট্রাকে করে স্বাধীনতার গান গাইতে গাইতে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যেতে দেখে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হন। আমাদের সঙ্গে থেকে গান রেকর্ড করেন। 

লিয়ার জানতে চাইলেন আমরা কী গাই। তিনি আমার কাছ থেকে গানের উচ্চারণ ও অনুবাদ চাইলেন। আমি তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমাদের গানের অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। লিয়ার পরবর্তী সময়ে তার চলচ্চিত্রের কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি। ২৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেই ফুটেজগুলো সংগ্রহ করে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ। একই সঙ্গে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল আমার করা সেই অনুবাদগুলোও। লিয়ার সেগুলো বেশ ভালোভাবেই সংরক্ষণ করেছিলেন।

গানের কথাগুলো এমন ছিল-

বল বলরে বল সবে বলরে বাঙালির জয়

বাংলাদেশের নদীর বুকে এই বলি গান গাহিয়া যা...

আর আমার অনুবাদ ছিল- 

'ওহ স্পিক অল, অ্যাবাউট দ্য ভিক্টরি অব দ্য বেঙ্গলি, অ্যান্ড সিং অব ইটস জয়, অ্যাস উই সেইল দ্য রিভারস অব বেঙ্গল। 

বেঙ্গল ইজ রিচ উইথ গোল্ডেন প্যাডি, ইয়ুথ ফ্লয়ারস অ্যান্ড ফ্রুটস- 

দেয়ার ইজ নো ওয়ান্ট অ্যান্ড দেয়ার ইজ নো ওরি। লেট আস অল সিং অব ইটস জয় অ্যাস ওয়েল সেইল দ্য রিভারস অব বেঙ্গল। 

আওয়ার রিভারস ফিলড উইথ ফিশ অ্যান্ড ট্রিস কাভারড উইথ ফ্রুটস, ইন দিন ইনকমপ্রাবল ল্যান্ড অব গোল্ডেন বেঙ্গল, হোয়াট হ্যাভ উই টু ওরি? সো, অ্যাস ওয়েল সেইল দ্য রিভারস লেট আস সিং অব দ্য জয় অব বেঙ্গল।'

এ রকম আরও বেশকিছু গানের অনুবাদ করে দিই তাকে। এই গানের বইটি সেই ৯ মাসের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দীর্ঘ নয় মাস হাজার হাজার পরিবারের সংগ্রাম, আমার পরিবারের সংগ্রাম আর লড়াইয়ের কথাগুলো ধারণ করা এই ইতিহাস লিখেছিলাম নিজের হাতে। 

আমার বাবা-মার পেশাগত কারণে সুখ্যাতি ছিল। বাবা খান সারওয়ার মুর্শিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ভাষার 'পাকিস্তানীকরণ' প্রতিহত করার আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। মা নুরজাহান মুরশিদ ছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রথম নারী সংসদ সদস্য। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন এবং '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আমার দুই ভাই-বোন এবং আমি ছাত্রাবস্থায় দেশ ত্যাগে বাধ্য হই। পাকিস্তানি সেনারা জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় বাবা-মাকে আটক করতে চেয়েছিল। আমরা শহর ছেড়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে অবশেষে ত্রিপুরা সীমান্তে একটি ছোট্ট গ্রামে আশ্রয় নিই। আমার বাবা-মা প্রবাসী সরকারে যোগদান করেছিলেন। আমার মনে আছে, আমার বাবা পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সব বক্তৃতার খসড়া তৈরি করতেন। মা দলের সদস্য হিসেবে অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। 

বাবা-মায়ের মতো ভাই-বোনেরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। বাকি ছিলাম শুধু আমি। আমিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাইলাম। কিন্তু কেউ আমাকে সঙ্গে নিলেন না। পরে আমি বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় যোগ দিই। আমরা ছিলাম তরুণ, উদ্যমী ও আদর্শবাদী। সন্‌জীদা আপা, ওয়াহিদ ভাই, মুস্তাফা মনোয়ার ও মাহমুদুর রহমান বেনু আমাদের রোল মডেল ছিলেন। ইনাম ভাই, স্বপনদা ও তারিক ভাই ছিলেন বড় ভাইয়ের মতো। ডালিয়া ও নাইলা ছিল স্কুলের বন্ধু। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চলে আসা শর্মিলা, শায়লা, বিপুল ভট্টাচার্য, লতা ও মোর্শেদ আলী ছিলেন আমাদের দলে। আমার মনে আছে, আমাদের গাওয়া বেশকিছু গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন মোর্শেদ। তিনি ছিলেন লোকগানের সুরকার। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। বিপুলও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তারিক (জিয়াউদ্দিন তারিক আলী) ভাই এ বছর কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গভীর সমবেদনা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের স্মরণ করছি। আমাদের দলে ৭০ জনের বেশি সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আমার মতো পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। তবে তাতে কিছু মনে হয়নি।

আমরা প্রতিদিন গানের অনুশীলন করেছি। ওয়াহিদ ভাই আমাদের গুরু ছিলেন। কী চমৎকার শিক্ষক ছিলেন তিনি! আমাদের দল কয়েকটি ছোটো ছোটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাস-ট্রেন ও ট্রাকে করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে শো করত অর্থ সংগ্রহের জন্য। আমরা মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করতাম এবং গান গাইতাম মনোবল দৃঢ় করতে। একবার আমাদের দল বাসে করে দিল্লি যায়, সেখানে অনুষ্ঠান করে, অর্থ সংগ্রহ করে এবং কেন্দ্রের একজন মন্ত্রীর কাছে আবেদন জমা দেয়। ওই সময় আমরা গান গেয়েছিলাম মুক্ত ভূখণ্ডের জন্য, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য। 

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রতী