১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান এবং পাকিস্তান গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ (এমএনএন ও এমপিএগণ) এক বিশেষ গোপনীয় স্থানে অধিবেশনে মিলিত হয়ে সবসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে 'স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশের 'স্বাধীনতার ঘোষণা (Proclamation of Independence)' নামে পঠিত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রচারিত হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, যেহেতু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সেহেতু ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হবে। একই সাথে আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য Laws Continuance Enforcement  Order জারি করা হয়। এই সময়ই সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়, যিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগ করা হয়। এভাবেই ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যাত্রা শুরু। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘোষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। যথার্থ কারণেই এই স্থানটি হয়ে যায় 'মুজিবনগর'।
যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো 'মুজিবনগর সরকার' রূপে। মুজিবনগর হলো প্রতীকী নাম; কার্যত এর প্রকৃত পরিচয় 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার'। আকারে ছোট হলেও ব্যাপক ও সুসংগঠিত ছিল এই সরকারের কর্মসূচি ও গঠন কাঠামো। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যে মনোগ্রাম সে সময় আমরা ব্যবহার করেছিলাম সেটি এখনও বিদ্যমান।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন যে, প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে 'অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী সরকার' নামে আখ্যায়িত করে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বিভিন্ন মেয়াদে শাসনকার্য পরিচালনার সময়কাল ব্যতীত অবশিষ্ট সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে হেয় করার।
সমকালীন ইতিহাসে বিপ্লবী প্রবাসী সরকারসমূহের মধ্যে কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেনারেল চার্লস দ্য গলের স্বাধীন ফরাসি সরকার (Free French Government), পোল্যান্ডের প্রবাসী সরকার এবং পি.এল.ও-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। কম্বোডিয়া ব্যতীত স্বাধীনতাকামী এই সকল সরকারের সদর দপ্তর নিজ দেশের অভ্যন্তরে ছিল না। কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকারের সদর দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিং-এ অবস্থিত ছিল। চার্লস দ্য গলের স্বাধীন ফরাসি সরকার এবং পোল্যান্ডের প্রবাসী সরকার লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। অন্যদিকে পি.এল.ও. দীর্ঘকাল প্রথমে লেবাননের বৈরুতে, জর্দানের আম্মানে এবং সর্বশেষ তিউনিসিয়ার তিউনিসে সদরদপ্তর স্থাপন করেছিল। পক্ষান্তরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৬ ডিসেম্বরে চূড়ান্তবিজয় অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত নিজস্ব ভূ-খণ্ড (মুক্তাঞ্চল) ও অপর দেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল। এ কারণেই, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে ১৭ এপ্রিলে শপথ নেওয়া সরকার কোনোভাবেই প্রবাসী সরকার নয়। কেবল নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্ন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয়।
২৫ মার্চশেষরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সেই সাথে ১০ এপ্রিল গৃহীত 'স্বাধীনতার ঘোষণা (Proclamation of Independence)'-এর মাধ্যমে ২৬ মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে এবং সেই সাথে কার্যকর হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। রাষ্ট্র যেমন চিরস্থায়ী, ঠিক তেমনি সরকারও চিরস্থায়ী। কেবল সরকার পরিচালনাকারী দল কিংবা ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটে। অতএব, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে গঠিত প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার- এসব কোনো বিশেষণেই আখ্যায়িত করা যাবে না।
২। প্রসঙ্গ : ২৫ মার্চ, ১৯৭১
আমি তখন তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার (বর্তমানের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত) জেলা প্রশাসক। জেলার সদরদপ্তর ছিল রাঙামাটি। ৭ মার্চের পর থেকেই মানসিকভাবে আমরা সকলেই তৈরি; কিছুএকটা ঘটতে যাচ্ছে। আমি ওই সময় প্রায় সর্বক্ষণ ওয়্যারলেসের কাছেই থাকতাম। ২৫ মার্চ রাত ১০টার পরে পুলিশের ওয়্যারলেস সেটে একেবারে পরিস্কারভাবে শুনলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করেছে। গোলাগুলির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল এবং ওই সময় জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম থেকে নেতৃবৃন্দ যোগাযোগ করে জানালেন যে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং আমরা যেন তাদের অস্ত্রশস্টসহ ইপিআর এবং পুলিশ পাঠাই।
এর কিছুক্ষণ পরেই কাপ্তাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কাপ্তাই প্রজেক্টের ম্যানেজার শামসুদ্দিন এবং আমার আত্মীয় ড. ফারুক আজিজ খান জানালেন যে সেখানে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। ই.পি.আর-এর পাঞ্জাবি সামরিক অফিসার বাধা দিচ্ছে, হারুন (ক্যাপ্টেন হারুন, ই.পি.আর) এগিয়ে গেছে, ওদের আক্রমণ করে বন্দি করবে। আমি তখনই তাড়াতাড়ি সকল বিওপিতে খবর পাঠালাম- 'তোমরা এখুনি অস্ত্রশস্ত্রদখলে নিয়ে তোমাদের পাঞ্জাবি অফিসারদের বন্দি করে রাঙামাটিতে চলে এসো।' এখানে উল্লেখ্য যে আমার দুই সহকর্মী এস এ সামাদ এবং এম ই শরীফ-এই দুইজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সীমান্তএলাকায় সকল বাঙালি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। মধ্যরাতের দিকে কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন টেলিফোন করে বললেন, 'আমরা ওদের আটকে ফেলেছি এবং অস্ত্রাগার আমাদের হাতে এসে গেছে। আমরা এখনি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, কালুরঘাটে গিয়ে আমি ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যোগ দেব।'
২৬ মার্চ সকালের মধ্যে আমাদের বার্তা পেয়ে রাঙামাটি থেকে পাঠানো লঞ্চে করে দলে দলে ই.পি.আর. আর পুলিশের বাঙালি জওয়ান তাদের জে.সি.ও.দের নেতৃত্বে সুদূর বরকল, দীঘিনালা, মারিশ্যা, মহালছড়ি- এসব জায়গা থেকে জমায়েত হলেন কোর্ট প্রাঙ্গণে। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা, খাওয়া আর ব্রিফিং এর ব্যবস্থা করা ছিল। তারা সবাই পরে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হলেন। পরে জেনেছি যে, ফরিদপুরের ডি.সি. ইউসুফ এবং গোয়ালন্দের এস.ডি.ও. রেজাউল হায়াত আমার সমস্ত নির্দেশ এবং ওয়্যারলেসে ই.পি.আর এবং পুলিশের কথোপকথন শুনেছেন।
৩। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে আমি তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার (বর্তমানের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত) জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিসংগ্রাম সংঘটনসহ কার্যকরভাবে শত্রুদের মোকাবিলায় অংশ গ্রহণ করি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনা ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করি।
২৬ মার্চ সারাদিন আমাদের তখন প্রচণ্ড ভয় যে পাকিস্তানিরা বোধহয় হেলিকপ্টারে রাঙামাটি আক্রমণ করবে। কাজেই রাঙামাটির খালি জায়গায় যাতে হেলিকপ্টারে তারা নামতে না পারে সেজন্য বড় বড় খুঁটি ধারালো করে পুঁতে রাখা হলো। আর রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ঘাগড়া নামক জায়গায় বিরাট গর্ত করে রাখা হলো যাতে ওই পথে আকস্মিকভাবে না আসতে পারে। গাছ কেটে সেগুলো ফেলে রাস্তা আটকানো হলো। অস্ত্রশস্ত্র যেখানে যা ছিল আনা হলো। ওপরের পাহাড়ে রাস্তার দিকে তাক করে বসানো হলো মেশিনগান। ই.পি.আর.-এর একটি ছোট দল সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিযুক্ত।
ওইদিন সন্ধ্যায় আমি বাইরে থেকে ফিরে দেখি আমার বারান্দায় এক ভদ্রলোক বসা। দীর্ঘদেহী, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রুক্ষ, শুস্ক চেহারা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম :কে আপনি? বললেন : আমি ক্যাপ্টেন রফিক। আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। আপনি আমাকে ভারতীয় সীমান্তে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আমি রামগড় হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে চাই। ওদের সাহায্য না পেলে আমাদের চলবে না। রামগড়ে আমাদের এস.ডি.ও-কে টেলিফোনে বললাম :'ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম যাচ্ছেন আপনার কাছে। তাঁকে তাড়াতাড়ি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।' একটা জিপে তিনি চলে গেলেন রামগড়ে।
তার পরের দিনই সংবাদ এলো যে, ক্যাপ্টেন রফিক পৌঁছে গেছেন, কিন্তু ভারতীয়রা তাঁর সাথে কথা বলতে রাজি নন। তারা বলেছেন, ডি.সি. সাহেব অথবা সিনিয়র অফিসার কেউ না হলে কথা বলব না। আপনি যদি আসেন তাহলে কথা বলতে পারে।
রাঙামাটি থেকে রামগড়। প্রবল বৃষ্টি। পাহাড়ি নদী বন্যার পানিতে খরস্রোতা হয়ে গেছে। কাঠের পুল বানিয়ে কোনোরকমে রাস্তা অতিক্রম করেছি। আমি আমার পরিবার নিয়েই গেছি। লোকজন নিয়ে আমি মহালছড়ি এবং খাগড়াছড়ি হয়ে রামগড়ে গেলাম ২৭ মার্চ। রামগড়ে ভারতীয় বি.এস.এফ.-এর ক্যাপ্টেন মাহেক সিং এসে আমাকে নিয়ে গেলেন নদীর ওপারে।
রামগড়ের ওপারেই সাবরুম। আগরতলা থেকে দক্ষিণের ত্রিপুরার ডি.সি. অশোকনাথ এলেন। তাঁর সাথে ডাকবাংলোতে বসে বৈঠক করলাম। তিনি বললেন, 'এখানে মেজর জেনারেল গঞ্জালভেস আসছেন, মাউনটেইন ডিভিশনের জি.ও.সি.। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান, আলাপ করে বুঝতে চান কী করা দরকার। তারপর আমাদের বি.এস.এফ.-এর কর্নেল ঘোষ আসবেন। ওরা সবাই আপনার সাথে কথা বলতে চান।' তাঁদের সঙ্গে ওখানেই দেখা হলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না তাঁরা কী চাইছেন। তাঁরা জানতে চাইলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধির খবর রাখি কিনা। আমি বললাম, এটা আমাদের সেনা-অফিসাররা ভালো জানেন।
আমি ভারতীয়দের সাহায্য করলাম মিজো বিদ্রোহীদের খবরাখবর দিয়ে। আর দিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বর্ণনা। আমার সাথে কিছু বিস্তারিত ম্যাপ ছিল। সেগুলোও সেনাদের খুবই প্রয়োজনে যেকোনো আর্মি চলাচলে (army movement)। আমি বললাম, দেখুন আমাদের তো এই অবস্থা, আমরা বাধা দিচ্ছি, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র না থাকাতে কিছুই করতে পারছি না। তাঁরা সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাইলেন। আমাকেই প্রথম চালান (consignment) গ্রহণ করতে বললেন। তাঁরা আমাকে প্রথম বাক্সভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দিলেন। প্রথম চালানটি ফেনী নদীর উত্তর তীরে বি.এস.এফ.-এর ক্যাপ্টেন মাহেক সিং আমাকে হস্তান্তর করলেন। আমি আবার সেগুলো ই.পি.আর. রামগড় উইং-এর জে.সি.ও.কে বুঝিয়ে দিলাম।
এর মধ্যে দুই-তিন দিন ওখানে থাকার পরে যখন মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হলো, রামগড়ে আমরা স্থির করলাম যে, এখানেই আমাদের লোকজন থাকবে। সেখানে সকলের সাথে পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা করা হলো। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসে আমাদের যাতে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য ধুমের পরে ফেনী ব্রিজের কাছে শুভপুর রেলওয়ে ব্রিজে আমাদের সৈনিকেরা অবস্থান নেয়। রামগড়ের ই.পি.আর.-এর উইং কমান্ডার মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ. রফিক এবং ক্যাপ. ভুঁইয়া শুভপুর ব্রিজের কাছে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কাজকর্ম সংঘটিত করে মার্চের শেষে আমি আবার ফিরে চলে গেলাম রাঙামাটিতে। রাঙামাটিতে গিয়ে দেখি অবস্থা খুব খারাপ। সরকারি সব বাঙালি কর্মকর্তা, পুলিশ, ই.পি.আর. কেউ নেই। শুনতে পেলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাঙামাটি অভিমুখে এগিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট তারা দখল করেছে।
২ মে পর্যন্ত আমরা রামগড় এবং আশপাশের সমগ্র অঞ্চল মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। এরপর পাকিস্তান বিমানবাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করলে রামগড়ে অবস্থিত প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করে প্রথমে ভারতের সাবরুমে এবং পরবর্তী সময়ে আগরতলায় স্থানান্তর করি। এ সময় আগরতলাতে অবস্থানরত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, সিলেটসহ সকল জেলার নেতৃবৃন্দ আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রশাসক নিয়োগ করেন। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং পরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই সরকারের সামগ্রিক দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজ উদ্দীন আহমদের নির্দেশক্রমে আমি উক্ত সরকারে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগদান করি।
৪। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের বড় শক্তি
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। দেশের সামগ্রিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি বিচার করা অত্যাবশ্যক। দীর্ঘদিনের মানসিক এবং বাস্তব প্রস্তুতির ফলে একটি জাতি তার নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নিয়ে, অধিকার নিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কখনও আইনানুগভাবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে, কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, কখনও বা কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতির। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এই প্রস্তুতি নিতে হয়। একজন মহাপরাক্রমশীল ব্যক্তি বা সমরনায়ক এলেন, ঘোষণা দিলেন আর তারপরেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, এরকম কখনও ঘটেনি। এই যে দীর্ঘ প্রস্তুতির কথা বললাম তার জন্য প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক নেতত্বের। যে নেতৃত্ব জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে, লালন করে তা বাস্তবায়নের জন্য ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যান। সেখানে বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুম-নির্যাতন নিশ্চিত জেনেও এমন বিরল নেতা নিজেকে কখনও লক্ষ্যচ্যুত করেন না। এমন নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নয়, সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁর সামগ্রিক নেতৃত্ব দিয়ে কখনও জনগণের মাঝ থেকে, কখনও কারান্তরালে থেকে, জাতিকে তার মূল লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ এবং অসীম ত্যাগ স্বীকারই এ মুক্তিযুদ্ধকে পরিণত করেছে একটি সার্থক জনযুদ্ধে। সকল স্তরের মানুষ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, বহন করেছে রসদ। প্রয়োজনবোধে কোনে কোনো ক্ষেত্রে শত্রুর মোবাকিলার জন্য নিজেরাও অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের চারদিকে গড়ে ওঠা অজস্র আশ্রয়-শিবির পরিণত হয়েছে যুবশিবিরে। সেখান থেকে বের হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখসমর, গেরিলাযুদ্ধ, শত্রুর ওপর আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়া, সড়ক-সেতু, বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন, সরবরাহ লাইন গুঁড়িয়ে দেওয়া, তথ্য সংগ্রহ, গোয়েন্দাগিরি, চিকিৎসাসেবা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিটে সংযোগ স্থাপন, দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলা- হেন কাজ নেই যা আমাদের বীর জনগণ করেনি। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, শ্রমিক বুদ্ধিজীবী, সকলে এই কাতারে শামিল ছিল নির্ভয়ে এবং স্বেচ্ছায়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হৃদয়ে। আর কণ্ঠে ছিল:
'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

৫। রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের সাথে মুজিব নগর সরকারের যোগাযোগ ও সমন্বয়
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিজের হাতে রেখেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। তার পরেই দুই জন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ; গ্রুপ ক্যাপ. এ কে খন্দকার ও কর্নেল এম এ রব। মূলত কর্নেল ওসমানী এবং গ্রুপ ক্যাপ. খন্দকার সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি দিতেন। ওই কঠিন সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চমৎকার চেইন অব কমান্ড ছিল। এগারোজন সেক্টর কমান্ডারের প্রত্যেকেই সরকারের নির্দেশাবলী বাস্তবায়ন করতেন।
রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের জন্য আঞ্চলিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপনা ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়োজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযোগিতা- এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Council) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এম.এন.এ/এম.পিরা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Zonal Administrative Officer) নিয়োগ করা হয়। সেই সাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বপর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের বিশেষ দায়িত্ব ছিল : (১) মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন ও পূর্ণ সহযোগিতা করা, (২) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলো পরিচালনা এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজের সমন্বয়, রিক্রুট ও ট্রেনিং-এ পাঠানোর ব্যবস্থা করা, (৩) শরণার্থীদের দেখাশোনা ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কাজের সমন্বয়সাধন করা, (৪) তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত হাজার হাজার পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও পোস্টার শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতরণের ব্যবস্থা করা, এবং (৫) হানাদার দখলীকৃত অঞ্চল থেকে কোনো সরকারি কর্মচারী এসে হাজির হলে তার নাম, পরিচয় লিপিবদ্ধ করে যোগ্যতা অনুসারে কাজে লাগানো ও বেতনের ব্যবস্থা করা।
৬। বিজয় ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে
৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ড গঠিত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে আমাদের আনুষ্ঠানিক এবং প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করতে হলো। থিয়েটার রোডের অফিস-প্রাঙ্গণ লম্বা একটি ব্যারাকে যৌথ কমান্ডের শাখা অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। এখান থেকে মিত্রবাহিনীর সমস্ত অগ্রযাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হতো। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাহিনীর কোন ইউনিট কোথায় যুদ্ধরত, কোন কোন শহর দখল করছে, ইত্যাদি তথ্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনিটর করা হতো। প্রতিরক্ষা সচিব এস এ সামাদ, সচিব নূরুল কাদের ও আমি ঘন ঘন গিয়ে খবর নিতাম। অনেক সময় গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার সাথে থাকতেন। এর মধ্যে প্রতিদিনই আমাদের একবার করে ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার ফোর্ট উইলিয়াম যেতে হতো। ওখানে বিশেষ স্থাপনাগুলো এবং গোপন অফিস সবই মাটির নিচে; বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না। অপরপক্ষে আমাদের যোগাযোগের মূলকেন্দ্র বাঙালি মেজর জেনারেল বি.এন. সরকার, যাকে ওই সময় বেসরকারি বিষয়াদি তদারক কর্মকর্তা (Civil Affairs Liaison Officer) নিয়োগ করা হয়েছিল। আমাদের অন্য অফিসাররা যোগাযোগ করতেন কর্নেল মরিস, লে. কর্নেল বাত্রা প্রমুখের সঙ্গে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আমাদের সামরিক পরিচয়পত্র (Military Identity Card) দেওয়া হয়েছিল যাতে আমাদের চলাচলে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হবার সংবাদ আসতে থাকে। আমরা ক্রমেই বুঝতে পারি যে, চূড়ান্ত বিজয় ঘনিয়ে আসছে। এখন সময় আর প্রতীক্ষার ব্যাপার। ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য এলেন কয়েকজন ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেনারেল। ঢাকা শহরে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক বোমাবর্ষণের পর তাঁরা তৎকালীন গভর্নমেন্ট হাউসে বোমাবর্ষণের অনুমতি চাইলেন। এই শেষ আঘাত হানলে শত্রুপক্ষ একেবারেই হতোদ্যম হয়ে পড়বে।
একটির পর একটি শহর আর অঞ্চল মিত্রবাহিনী দ্বারা মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান বাহিনীর মনোবল বলতে কিছু ছিল না। ১৩ ডিসেম্বর থেকে বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হতে থাকে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ-এর শত্রুর প্রতি নির্দেশ: 'সম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করো'। ১৬ ডিসেম্বর সকালে খবর এলো জেনারেল নিয়াজি ওইদিনই আত্মসমর্পণ করবেন। জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আত্মসমপর্ণের দিনক্ষণ নির্ধারণ করলেন। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে এলো কাঙ্ক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ; মুক্ত হলো প্রিয় মাতৃভূমি।

বিষয় : প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তির পথ

মন্তব্য করুন