সরকারিভাবে পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হলেও সেগুলো পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। তাই সরকার যে উদ্দেশ্যে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, তার লক্ষ্য অনেকাংশেই পূরণ হচ্ছে না। এ জন্য আদিবাসী শিশুদের জন্য তাদের নিজ নিজ ভাষার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার। প্রয়োজনে শিক্ষাগত যোগ্যতায় খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও প্রতিটি ভাষার শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযান ও সমকাল আয়োজিত 'প্রাক-প্রাথমিক স্তরে এমএলই :কর্ম-অভিজ্ঞতা ও করণীয়' শীর্ষক ওয়েবিনারে গতকাল সোমবার বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, দেশে প্রায় ৫৭টি আদিবাসী ভাষা আছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ভাষারই পাঠ্যবই রচনা করতে হবে, যেন আদিবাসী শিশুরা নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা পেতে পারে। সারাদেশে মাল্টিলিটারাল এডুকেশন (এমএলই) কার্যক্রম আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে বলেও অভিমত দেন তারা।

ওয়েবিনারে সভাপ্রধান হিসেবে স্বাগত ভাষণ দেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।

ওয়েবিনারে এমইএল কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন নেটস্‌ বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এডুকেশন) মঞ্জুশ্রী মিত্র। নওগাঁ অঞ্চলে এ-সংক্রান্ত কর্ম-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক জুরানা আজিজ। আলোচনায় অংশ নেন এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌরভ শিকদার, নেটস্‌ বাংলাদেশের ডিরেক্টর শহিদুল ইসলাম, আদিবাসী মুক্তিমোর্চার সভাপতি যোগেন্দ্র নাথ সরেন, জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, সেভ দ্য চিলড্রেনের ঊর্ধ্বতন কার্যক্রম ব্যবস্থাপক মেহেরুন নাহার স্বপ্না, ইউনেস্কো বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অফিসার শিরিন আকতার, আশ্রয়-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান আলী, গণসাক্ষরতা অভিযানের উপদেষ্টা জ্যোতি এফ গোমেজ এবং উপপরিচালক তপন কুমার দাশ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আদিবাসীদের ভাষায় পাঠ্যবই দেওয়া হলেও পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। আদিবাসীদের মধ্য থেকেই এ বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক দিতে হবে। পৃথিবীতে বর্ণমালা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। যেসব ভাষার বর্ণমালা নেই, সেসব ভাষায় তারা কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করেছে, তার উদাহরণ আমরা এশিয়াতেই পাই। কেবল প্রাথমিক নয়, প্রাথমিক থেকে আরও উচ্চস্তরেও আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যবই কী করে রচনা করা যায়, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে শিক্ষা অধিকার হিসেবে নেই, আছে মূলনীতি হিসেবে। আমাদের কতগুলো মৌলিক বিষয় অধিকার হিসেবে সংবিধানে নেই। অথচ অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয় দুটি সামরিক সরকারের আমলে সংবিধানে ঢোকানো হয়েছে। এটা বিজয়ের মাস। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই সংবিধানে দেশের সব নাগরিকের বৈষম্য কমানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি। এর মধ্যেই আমাদের আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদান কাজে আরও এগিয়ে যেতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বহুভাষিক শিক্ষাদান কার্যক্রম এগিয়ে নিতে অনেক আগেই কাজ শুরু করা হয়েছে। এ কাজকে আরও বেগবান করতে হবে। মাতৃভাষা শিক্ষা আর মাতৃভাষায় শিক্ষা- দুটির মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। দেশে প্রায় ৫৭টি আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। অথচ আমরা পাঠ্যবই পেয়েছি মাত্র পাঁচটি ভাষায়। বহুভাষিক শিক্ষাকে কীভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়েই এ আলোচনা। তিনি বলেন, কাউকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলার কোনো অধিকার আমার আছে বলে মনি করি না। তাই আদিবাসী বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা ও সাদ্রি ভাষায় এখন আমরা এনসিটিবি থেকে বই দিচ্ছি। যেসব বই দেওয়া হয়েছে, আগামীতে সেগুলোর আরও ট্রাইআউট ও ইফেকটিভনেস যাচাই করা হবে। তিনি বলেন, আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যবইয়ের চাহিদা যাচাই আগে করা দরকার। কেননা কোন কোন ভাষার বই আগে দরকার, তা জানা প্রয়োজন। আবার শিখনসামগ্রী না থাকায় শুধু পাঠ্যবই তেমন কোনো কাজে আসবে না। প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন বইগুলো পড়াতে। এ বিষয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি রিডিং ম্যাটেরিয়াল (এসআরএম) ডেভেলপেরও চেষ্টা করছি।

ড. মনজুর আহমদ বলেন, কোনো কোনো নৃগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করে আমরা নিজেরাই ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি। বহুভাষী শিক্ষা একসময় সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এখন তা হয়েছে। আরও অনেক কিছুই করার বাকি আছে। তিনি বলেন, আদিবাসী শিশুদের শেখানোর মূল কৌশল হিসেবে তাদের নিজ নিজ ভাষার সহকারী অথবা সহযোগী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।

ড. সৌরভ শিকদার বলেন, আদিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের বিষয়ে অন্তত সাতটি গবেষণার সঙ্গে নিজে যুক্ত ছিলাম। সাদ্রি ভাষায় ক্লাসে কথা বলা হলে তার অন্তত ৩০ শতাংশ বাঙালি শিক্ষার্থীরাও বুঝতে পারবে। তবে চাকমা, মারমা ও গারোদের মান্দি ভাষায় পড়ানো হলে তা বোঝা যাবে না। তিনি পরামর্শ দেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত যে বইগুলো হয়েছে, তা আগামীতে যাচাই হওয়া উচিত। কতজন শিক্ষক লাগবে, কত শিক্ষার্থী আছে, কতটি ভাষায় বই দরকার, এসব প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে হবে। বারবার বলেও এ কথাগুলোর বাস্তবায়ন করাতে পারছি না। শিক্ষক প্রশিক্ষণ দরকার। সাপ্লিমেন্টারি ম্যাটেরিয়াল ডেভেলপ করা দরকার। কেউ যেন বাদ না পড়ে যায়। যেসব ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সেদিকে আগে নজর দেওয়া দরকার।

শেখ রোকন বলেন, ভাষা হচ্ছে নদীর মতো। নদীর শাখা নদী, উপ নদী থাকে। কিন্তু সেগুলোও নদীর মূল ধারা বয়ে যাওয়ার জন্য সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি ভাষার প্রবহমানতার জন্য সব ভাষা, সব উপভাষা সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, সমকাল সবার ভাষা সুরক্ষার জন্য সব সময় সোচ্চার। এ ধরনের সব উদ্যোগে সমকাল সব সময়ই পাশে আছে, থাকবে।

মঞ্জুশ্রী মিত্র বলেন, নেটস্‌ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নওগাঁর মহাদেবপুর ও ধামইরহাট উপজেলা দুটিতে আদিবাসী শিশুদের মধ্যে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান কার্যক্রমের প্রকল্পে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, শিশুরা এতে খুব দ্রুত শিখছে। আমরা চাই, প্রতিটি শিশু যেন তার মায়ের ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার সংযোগ ঘটিয়ে ভালোভাবে শিখনফল অর্জন করতে পারে।

নওগাঁয় কর্ম এলাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জুরানা আজিজ বলেন, দুই উপজেলায় ৩০৬ আদিবাসী শিশুকে নিয়ে কাজ করে দেখা গেছে, তারা ভাষাভীতি দ্রুত কাটিয়ে উঠেছে। তাদের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিশুদের উপস্থিতি বেড়েছে। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বহুভাষিক শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে আদিবাসী শিশুদের ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসবে।

নেটস্‌ বাংলাদেশের ডিরেক্টর শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০০১ সাল থেকে নেটস্‌ বাংলাদেশ কাজ করছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা মানবাধিকারের বিষয়টি ফোকাস করে আমরা কাজ করছি। মাতৃভাষায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা গ্রহণ তাদের অধিকার। এজন্য দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। আমরা যদি আমাদের মধ্য থেকে আদিবাসী ভাষাগুলো ক্রমে হারিয়ে যেতে দেই, তা হবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। তিনি এ ধরনের আলোচনা আয়োজনের জন্য সমকাল ও গণসাক্ষরতা অভিযানকে ধন্যবাদ জানান।

আদিবাসী যোগেন্দ্র নাথ সরেন বলেন, আদিবাসীরা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকায় তাদের মধ্যে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া খুব সহজ কাজ হবে না। তবু যারা এই প্রকল্পে কাজ করেছেন, তাদের স্থায়ী করা হোক এবং ১২০০ টাকা সম্মানীর বদলে তাদের বেতন দেওয়া হোক।

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, বহু পাইলটিং আমরা দেখেছি, এখন মূল কাজের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আদিবাসী সব শিশু যেন নিজের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করতে পারে, সেই সুযোগ চাই। পাংখুয়া, কুনি, রাহান, রেমিট্রা- এসব ভাষায় খুব স্বল্প ভাষাভাষি রয়েছে। তারা মারা গেলে এসব ভাষা হারিয়ে যাবে। তাহলে এসব ভাষার কী হবে? এসব ভাষাও যদি মারা যায়, তাহলে আমরা দেশ থেকে বৈচিত্র্য হারাব।

মেহেরুন নাহার স্বপ্না বলেন, পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যবই হয়েছে। আরও দুটি ভাষায় বই তৈরির বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। আরও যেসব ভাষা রয়েছে, সেগুলোর বই তৈরির উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।

শিরিন আকতার বলেন, এনসিটিবি প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত কম্পিটেন্সি বেজ শিক্ষাক্রম তৈরির কাজ শুরু করেছে। যারা আদিবাসী স্কুলে পাঠদান করছেন, এসব বিষয়ে তাদেরও মতামত এবং অভিজ্ঞতা নেওয়া দরকার।

ড. আহসান আলী বলেন, ওঁরাওদের ভাষা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সাঁওতালসহ সমতলের আদিবাসীদের দিকে সরকারকে সমানভাবে নজর দিতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের উপদেষ্টা জ্যোতি এফ গোমেজ বলেন, সরকারি উদ্যোগে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করে আদিবাসী শিশুদের পড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে হলেও আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক তপন কুমার দাশ বলেন, আমরা চাই প্রতিটি শিশু নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করবে। নেটস্‌ যেমন নওগাঁয় একটি সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে, মাল্টিলিটারাল এডুকেশন নিয়ে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর একটি ডকুমেন্টেশন দরকার। আদিবাসী প্রতিটি শিশুও যেন তাদের নিজ নিজ বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে বাঙালি শিশুদের মতো একই যোগ্যতা অর্জন করতে পারে শিক্ষালাভের মাধ্যমে।