মালিকপক্ষ প্রস্তাবনার চেয়েও বেশি মজুরি দিতে রাজি

মজুরি বাড়ানোর দাবিতে লাঠিসোটা নিয়ে বিক্ষোভ করে গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বুধবার মিরপুর ১০ নম্বর থেকে তোলা । ছবি: সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৭ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:৪৭
তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণে শুরুতে মালিকপক্ষ যে প্রস্তাবনা দিয়েছিল; সবকিছু বিবেচনায় এখন তার চেয়ে বৃদ্ধি করতে রাজি হয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি ন্যূনতম মজুরি মজুরি বোর্ডের পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে নতুন প্রস্তাবনা দেবে মালিকপক্ষ। এর পর বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে এবং ১ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হবে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ে পঞ্চম সভা হয়। সরকার, মালিক ও শ্রমিক– তিন পক্ষের সভা শেষে ব্রিফিংয়ে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করা পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং শিল্পের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় গত সপ্তাহে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন তারা। তবে এখন সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবনার চেয়ে বেশি মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বোর্ডের আগামী বৈঠকে লিখিত আকারে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে শিল্প মালিকদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নভেম্বরের মধ্যে আমরা ন্যূনতম মজুরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব এবং ১ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হবে। যে প্রস্তাব মালিকরা আগে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে বৃদ্ধি করতে তারা রাজি হয়েছেন।’
গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। এর বিপরীতে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি প্রস্তাব করেন। মালিকপক্ষের এ প্রস্তাব অত্যন্ত কম বলে মনে করেন শ্রমিকরা। প্রস্তাবের পরদিন থেকেই বিভিন্ন কারখানায় মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নামে শ্রমিকরা। গাজীপুর, ঢাকাসহ অনেক কারখানায় ছড়িয়ে পড়া এ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। সরকারি দল এবং সরকারবিরোধী দল এ আন্দোলনে বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। অনেক এলাকায় কারখানা আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল মজুরি বোর্ড বৈঠক করে।
বৈঠক শেষে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের আগেই শ্রমিক অসন্তোষ হওয়ার কথা নয়। এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। সাধারণ শ্রমিক কোনো প্রকার ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। তারপরও কাজে ফিরতে সব শ্রমিকের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা বলেন, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। মজুরির ক্ষেত্রে ৭টি গ্রেড থেকে ৫টিতে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ একমত। সবকিছু ঠিক থাকলে বর্ধিত মজুরি ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি ব্রিফিংয়ে বলেন, শ্রমিকদের অবস্থা দেখতে হবে; একই সঙ্গে শিল্পের সক্ষমতাও দেখতে হবে। সমন্বয় করেই বেতন নির্ধারণ করতে হবে। মালিকদের বিবেচনা করতে হবে– শ্রমিক কত মজুরি পেলে তার জীবন নিরাপদে থাকবে। শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, যৌক্তিক শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থন করব। তবে কোনো ভাঙচুর-বিশৃঙ্খলাকে সমর্থন করি না। সাম্প্রতিক আন্দোলনে অন্য কোনো পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলেও মনে করেন রনি।
কাজ নেই, মজুরি নেই: বিজিএমইএ
গতকাল এক বৈঠকে ‘কাজ নেই, মজুরি নেই’– এই নিয়ম কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ। কারখানায় শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলায় অংশ নিয়ে কাজ বন্ধ রাখলে কিংবা বিশৃঙ্খলার কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হলে শ্রম আইন অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিভিন্ন কারখানার মালিকের এক আলোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত সভায় অন্তত ২০০ কারখানার মালিক উপস্থিত ছিলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, সরকার গঠিত মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকেই নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা। এর আগেই এ ধরনের আন্দোলন, সহিংসতা ও ভাঙচুর কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক দিনে শতাধিক শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। তারা সবাই জানিয়েছে, ভাঙচুরের সঙ্গে তারা জড়িত নয়। তাহলে এগুলো কারা করছে– প্রশ্ন রাখেন বিজিএমইএ সভাপতি।
সভার শুরুতে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, কারখানা ভাঙচুর হলে বা শ্রমিকরা কাজে না গেলে ১৩(১) ধারা বাস্তবায়নে সবাইকে একমত হতে হবে। এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হবে, সবাই তা মানবে। এ ছাড়া শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে এলাকায় সমস্যা হবে, সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্য বক্তারা তাঁর এ প্রস্তাব সমর্থন করে কথা বলেন।
কারখানা ভাঙচুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে কিছু ভিডিও ফুটেজ হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব ভিডিওতে কারখানায় হামলার প্রমাণ আছে। প্রাথমিক তদন্তও হয়েছে, কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আলোচনায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, পাঁচ বছর পরপর মজুরি বোর্ডের সভা বসে। কিন্তু নির্বাচনের আগে হওয়ায় দেশি-বিদেশি একটি চক্র এই সময়ের সুযোগ নিতে চাইছে। অনেক ষড়যন্ত্র ভর করেছে এই খাতে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী এমপি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানা খোলা রাখা যাচ্ছে না; আবার বন্ধ রাখলেও আক্রান্ত হতে হচ্ছে। সরকারের কাছে কারখানার নিরাপত্তা দাবি করেন তিনি। বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, যারা মারামারি করছে, কারখানা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারা সবাই বহিরাগত। যারা দেশের অগ্রগতি চায় না, তারা এসব কাজ করছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, কারখানা এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের নিরাপত্তা দেবে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। গতকাল সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শিল্প মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানান তিনি।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের বিষয়ে ফারুক হাসান সমকালকে বলেন, আন্দোলনের নামে পোশাক কারখানায় ভাঙচুর এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা চেয়েছি আমরা। সহিংসতার পেছনে কারা, তা খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।
মজুরি পুনর্নির্ধারণে সচেষ্ট সরকার
তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলমান বলে সংসদকে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। গতকাল সংসদে প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়ে সরকারি দলের নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি।