টানা হরতাল-অবরোধে চাষির মলিন মুখ

ঈশ্বরদীর মুলাডুলি আড়তের সামনের মহাসড়কে সবজি ফেলে বৃহস্পতিবার বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের প্রতিবাদ জানান কৃষকরা -সমকাল
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:৪৪ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৫৮
পাবনার ঈশ্বরদীর মুলাডুলিকে বলা হয় ‘সবজি স্বর্গ’। সেখানকার ঘরে ঘরে, মাঠে মাঠে হয় সবজি আবাদ। ধারকর্জ, এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রতি বছর চাষ করেন কৃষক। ফসল উঠলে দেনা মিটিয়ে কষেন লাভের হিসাব। চার দিনের হরতাল-অবরোধে তাদের সবার কপালেই দুশ্চিন্তার রেখা। শীতকাল সামনে রেখে যে স্বপ্ন তারা মনে এঁকেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় তা ধূসর হয়ে যাচ্ছে। অন্য সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতার পদভারে মুলাডুলি কাঁচাবাজার গমগম করলেও এখন অনেকটাই বিরান!
চাষি আব্দুল আজিজের ভাষ্য, শীতের সবজি ওঠে প্রতিদিন। এক দিন বাজার ধরতে না পারলে সবজি মাঠেই নষ্ট হয়। কপির ফুলে বীজ হয়ে যায়, মুলা সময়মতো না তুললে মোটা ও শক্ত হয়ে যায়, শিমের ভেতরে বিচি বড় হয়ে যায়– এমন সব ফসলই নষ্ট হয়। পরে আর এগুলো বাজারে বিকোয় না। এবার তা-ই ঘটেছে। বাধ্য হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার কাঁচা সবজি পাবনা-রাজশাহী মহাসড়কে ফেলে হরতাল-অবরোধবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো কৃষক।
শুধু ঈশ্বরদী নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সারাদেশে ভেঙে পড়েছে পরিবহন ব্যবস্থা। হাটবাজারে ক্রেতা না থাকায় ধান, আলু, সবজি, দুধ, ফুলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষি। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গতকাল মধ্যরাত থেকে জেলেরা আশা নিয়ে সাগরে নামলেও সেই মাছ বিপণনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। অবরোধে বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে না পারায় মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদনে নেমেছে ধস। অন্যদিকে বেড়ে গেছে সার, ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের দাম। অল্প কিছু ট্রাক চলাচল করলেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। কৃষি খাতে এ টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারবিরোধীদের আগামী রোববার থেকে ফের দু’দিনের অবরোধের ডাকে নিরাশ কৃষককুল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে কৃষিপণ্য পরিবহনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। কৃষি খাতের সুরক্ষায় কৃষিপণ্য অবরোধের আওতামুক্ত রাখা কিংবা ট্রেনে পরিবহনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নইলে শুধু কৃষক নয়, এ খাতের সঙ্গে জড়িত সব পেশার মানুষ বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন।
গ্রামগঞ্জের মাঠে মাঠে এখন শীতকালীন সবজির সবুজ ঢেউ। হরতাল-অবরোধের কারণে এ সবজি পাইকারি বাজারে আনলেও নেই ক্রেতা। ফলে কষ্টে ফলানো সবজি খেতেই নষ্ট হচ্ছে। হামলার ঝুঁকিতে ট্রাক ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কেনাবেচা বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন আড়তের ব্যবসায়ীরা। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে প্রতিদিন প্রায় শত ট্রাক সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন ঈশ্বরদীর কৃষকদের ১০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
কৃষকরা বলেন, ২০১৪ সালের টানা হরতাল-অবরোধে কৃষকরা পথে বসেন। পরে করোনাভাইরাসে আরেক দফা ক্ষতির মুখে পড়েন তারা। এর পর জ্বালানি তেল, সারসহ সব কৃষি উপকরণের দাম বাড়ার মধ্যেও যুদ্ধ করে টিকে থাকা কৃষকের কাছে নতুন করে ‘অবরোধ’ কাঁদিয়ে ছাড়ছে।
বগুড়ার সবজির বড় মোকাম মহাস্থানহাটে বুধবার সাতসকালে ক্ষেত থেকে সবজি তুলে আনেন চাষিরা। ক্রেতা-বিক্রেতা আর আড়তদারদের ভিড় ছিল নিত্যদিনের মতো। তবে ছিল না সবজির কাঙ্ক্ষিত দাম। দুই দিন আগে মহাস্থানহাটে যে ফুলকপির পাইকারি দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা, সেই ফুলকপির দাম ২৫ টাকায় নেমেছে। ৪০ টাকা কেজির মুলা ১০ টাকা এবং ৪০ টাকার বেগুন ২৭ টাকায় নেমেছে।
সবজি চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের ফাঁদত কৃষক মরিচ্চে। আর লেতারা কেউ গদির জন্যি আন্দোলন করিচ্চে, কেউ গায়ের জোরে গদি রক্ষা করিচ্চে। ইংকা করে হরতাল-অবরোধ হলে সবজি খ্যাতত পচে যাবি, কিনবার লোক পাওয়া যাবি না।’ যশোর সদর উপজেলার বারীনগর বাজারে কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘ভাই, কৃষক আর বাচপেন না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার জীবন যায়। আমাগের অবস্থা এখন তাই।’
মহাস্থানহাট সবজি, কাঁচা ও পাকা মাল ব্যবসায়ী এবং আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, অবরোধের প্রথম দিনে ক্ষেত থেকে সবজি তুলে হাটে এনে দাম না পেয়ে অনেক কৃষক কেঁদেছেন। কৃষকের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ঝুঁকি নিয়ে আড়তদাররা কিছু সবজি কিনেছেন। এখন কেনা সবজি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মোকামে পাঠাতে ট্রাক ভাড়া গড়ে ১০ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে। অবরোধের কারণে ঝুঁকি নিয়ে কেউ পণ্য পরিবহন করতে চাইছেন না।
শুধু সবজি নয়, এবার আমন মৌসুমের নতুন ধান বাজারে ওঠা শুরু করলেও দাম পাচ্ছেন না কৃষক। সরকারি গুদামে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে ধান কেনা হলেও তাদের বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়।
এদিকে যশোরের ঝিকরগাছার ফুল চাষ সমৃদ্ধ গদখালীর কয়েকশ চাষি অবরোধে কঠিন দুর্বিপাকে পড়েছেন। গদখালী বাজারে এ মৌসুমে প্রতিদিন বেচাকেনা হতো ২০ লাখ টাকার ফুল। এখন অবরোধের কারণে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা। পানির দরেও ফুল কেউ কিনছে না।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, অবরোধের আগে প্রতিদিন গদখালী বাজারে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হতো। এখন দেড় থেকে দুই লাখ টাকার কেনাবেচা হয়।
অবরোধের কারণে টান পড়েছে দুধ সরবরাহেও। মিষ্টিজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা মালিকরা দুধ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বাজারে দুধের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। সিরাজগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬৬ টাকা লিটারের দুধ ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল মধ্যরাত থেকে নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশ শিকারে নেমেছেন জেলেরা। তবে অবরোধের কারণে মাছ বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন জেলে ও আড়তদাররা। এদিকে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হ্যাচারির উৎপাদিত মাছের রেণু ও পোনা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। অবরোধে পাঠাতে না পেরে হ্যাচারি মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। যশোর জেলা মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান জানান, রেণু দু-এক দিনের বেশি রাখা যায় না। অবরোধের কারণে কোথাও নিরাপদে রেণু পাঠানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কুল ময়েজ বলেন, ‘আমরা কৃষকরা তো কোনো দলের না, রাজনীতিও করি না। অথচ কৃষকরা এখন বড় ক্ষতির মুখে। আমাদের কথা কেউ ভাবছে না।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে কৃষকের কোনো ভূমিকা নেই এবং কৃষকদের স্বার্থেও তা করা হচ্ছে না। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারে।’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন ইশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি সেলিম সরদার]