জন্মসনদ যেন সোনার হরিণ

.
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:০৯ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৯
নগরবাসীর সেবাপ্রাপ্তি সহজ করতে গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের হাতে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের দায়িত্ব দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সেবা সহজ করার কথা বলা হলেও এখন নগরবাসী আরও নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। এমনিতেই রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভারে ঢোকা মুশকিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নিয়মের বেড়াজাল। যাদের জন্ম ঢাকায় ও যারা রাজধানীতে স্থাবর সম্পত্তির মালিক, শুধু তাদের জন্মনিবন্ধনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে করা যাচ্ছে। অন্যদের জন্মনিবন্ধন নিজ নিজ জন্মস্থান থেকে করতে হবে। ফলে রাজধানীতে জন্ম নেওয়া শিশুদের নিবন্ধন নানা কসরত করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে করা গেলেও অন্য অভিভাবকদের দৌড়াতে হচ্ছে নিজ নিজ শহর বা গ্রামে।
দীর্ঘদিন ধরেই জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে দেশবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। অথচ স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে পাসপোর্টের আবেদন– এমন ১৯ ধরনের কাজে প্রয়োজন হয় জন্মনিবন্ধনের। সম্প্রতি আরও একটি সেবায় জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। যে কোনো সরকারি হাসপাতালে এখন চিকিৎসক দেখাতে গেলে আউটডোরে টিকিট কিনতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদের অনুলিপি দেখাতে হয়। যাদের বয়স ১৮ বছরের কম, সরকারি হাসপাতালগুলোতে জন্মসনদ ছাড়া তারা চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে না। এ ছাড়া এরই মধ্যে স্কুলগুলোতে শুরু হয়েছে ভর্তি কার্যক্রম। এ অবস্থায় জন্মসনদ সংগ্রহে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সারাদেশের মানুষ। যারাই জন্মনিবন্ধন করাতে যাচ্ছে, তাদের ঘাম ছুটছে। অনেক অভিভাবকের মনে তৈরি হয়েছে উৎকণ্ঠা।
ভোগান্তির মূল কারণ সার্ভার ডাউন। দিন-রাত মিলিয়ে ২৩ ঘণ্টাই সার্ভার ডাউন থাকে। এ খাত থেকে কোনো রাজস্ব না মেলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কয়েক মাস বন্ধ রেখেছিল জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনেক দেনদরবার শেষে ৫ অক্টোবর থেকে নিজস্ব সার্ভার তৈরি করে নিবন্ধনের কাজ শুরু করেছে ডিএসসিসি।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির সমকালকে বলেন, ‘সার্ভার সম্পর্কে কথা বলতে চাই না। আমরা আমাদের মতো করে একটি সার্ভার চালু করেছি। সেই সার্ভারের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর সংযোগ দেওয়া আছে। কাজেই কেউ স্কুলে ভর্তি বা পাসপোর্ট করার সময় ডিএসসিসির সার্ভারে জন্মনিবন্ধনকারীদের তালিকাও তারা দেখতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না। আর ডিএসসিসি নতুন নিজস্ব সার্ভার ব্যবস্থায় জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের কার্যক্রম শুরুর পর সেবাপ্রার্থীদের কোনো অভিযোগ নেই। সবাই সহজেই সার্ভারে ঢুকতে পারছে। এ সার্ভারে কয়েক হাজার নগরবাসীর জন্মনিবন্ধনও হয়ে গেছে।’
তবে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে দায়িত্ব দেওয়ার পর ডিএনসিসি এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের (আগারগাঁও-তালতলা) কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন বলেন, ‘আমরা সার্ভারেই তো ঢুকতে পারছি না।
একটা পর্যায় ওটিপি পর্যন্ত আসে। পরে সাবমিট করতে গেলে আর হয় না। এ জন্য আমি সেবা দিতে পারছি না।’ ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর-শেরেবাংলা নগর) আসনের অধীনে থাকা সাত কাউন্সিলরের একই অবস্থা।
পাইকপাড়া-কল্যাণপুর এলাকার কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান বলেন, ‘যারা জন্মনিবন্ধনের জন্য আসছেন, তাদের বলছি– আপনারা বাইরের কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে সবকিছু সাবমিট করে সনদ প্রিন্ট দিয়ে আনেন। আমরা সই করে দেব।’
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে অবেদন করতে গিয়েই বড় সমস্যায় পড়ছেন তারা। মগবাজার এলাকার বাসিন্দা একরামুল হক বলেন, ২০১০ সালের দিকে পরিবারের সবার জন্মনিবন্ধন করেন। তবে মেয়ের স্কুল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি জানায়, তার জন্মসনদ সার্ভারে নেই। সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তাদের সবার জন্মনিবন্ধন নতুন করে করতে হবে। এ জন্য কাউন্সিলর অফিসে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। মগবাজারের কাউন্সিলর মুক্তার সরদারের কার্যালয়ে গেলে জানানো হয়, বাইরের কম্পিউটার দোকান থেকে সব সাপোর্টিং কাগজপত্র দিয়ে অনলাইনে সাবমিট করে সনদ প্রিন্ট দিয়ে আনতে হবে। তিনি যান পাশের এক কম্পিউটারের দোকানে। তবে সার্ভার দুর্বল থাকার কারণে মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র আর অনলাইন আবেদনে যুক্ত করতে পারেননি। আর একরামুল হক দম্পতির জন্মনিবন্ধন ঢাকায় হবে না বলে কম্পিউটারের দোকান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাদের জন্মস্থান ঢাকা নয়। তিনি বলেন, এখন তাহলে কী করব?
এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান সমকালকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো সার্ভার দেওয়া সম্ভব নয়। যারা সার্ভার ডাউনের কথা বলছে, তারা মিথ্যা কথা বলছে। এ সার্ভার নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এখন সবাই সার্ভারে ঢুকতে পারছে। কোনো সমস্যা নেই। আর নিয়ম তো সবার মানতেই হবে।’