ঢাকা বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

অবরোধের আগুনে দগ্ধ বাসচালক

জীবন সংকটে সবুজ, অর্থ  সংকটে পরিবার

.

 বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:৩৪ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৩৪

দুর্বৃত্তের ছোড়া পেট্রোল বোমায় ঝলসে গেছে বাসচালক মো. সবুজের মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। মুখের চামড়া উঠে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। মোবাইল ফোনে বাবার সেই চেহারা দেখে আঁতকে উঠছে তাঁর দুই শিশুসন্তান। কান্নায় ভেঙে পড়ছে তারা। তারা বলছে, বাবাকে চেনা যাচ্ছে না। চামড়া উঠে মুখ অনেকটা বিকৃত হয়েছে। কারা এই হাল করেছে তাদের বাবার? কাঁদতে কাঁদতে তারা বলছে, ‘আব্বুর চেহারা এমন হলো কেন? তার মুখ ঠিক হবে না? আব্বু আগের চেহারায় ফিরবে তো?’

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন রোববার সকালে রাজধানীর মেরাদিয়ায় চলন্ত বাসে এক দুর্বৃত্তের ছোড়া পেট্রোল বোমার আগুনে দগ্ধ হন সবুজ। তিনি বাসটি চালাচ্ছিলেন। ওই দুর্বৃত্ত বাসে আগুন দিতে চেয়েছিল। সেটা বুঝতে পেরে সবুজ নামার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেট্রোল বোমা গিয়ে লাগে তাঁর শরীরে। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে তাঁর শরীর। বাসটিতে আংশিক আগুন লাগলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দুর্বৃত্তের আগুন সবুজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। দরিদ্র সবুজের পরিবার এখন তাঁর চিকিৎসার খরচ জোগাতে অর্থ সংকটে ধুঁকছে। 

স্ত্রী-সন্তানের ভাত জোগাতে সবুজ বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তবে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁর জায়গা হয় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। শ্বাসনালিসহ শরীরের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে তাঁর। চিকিৎসকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। 

দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ঢাকার মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে একটি টিনের ঘরে ভাড়ায় থাকেন সবুজ। তাঁর ছেলে রোহান হোসাইনের বয়স সাত বছর আর মেয়ে স্বপ্না আক্তার লামিয়ার বয়স ৯ বছর। সবুজের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার জন্য টাকা পাঠান নিয়মিত। একার উপার্জনে পেরে উঠছিলেন না তিনি। তাই স্ত্রীকেও অন্যের বাড়িতে খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজে দেন। মাসে স্ত্রীর ৪ হাজার টাকা আর নিজের আয়ে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল তাঁর সংসার। কোনো সঞ্চয় নেই। উল্টো ঋণ আছে তাঁর। এখন অথৈ সাগরে পড়েছে সবুজের পরিবার। ওষুধ ও সংসার খরচ কীভাবে জোগাড় করবেন– তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবুজ ও তাঁর স্ত্রী রুশিদা খাতুন। 

গতকাল সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা যায়, অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়া হয়েছে সবুজকে। সামনে করিডোরের মেঝেতে বিমর্ষ অবস্থায় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছেন রুশিদা। তিনি জানান, রোববার তাঁর ছেলেমেয়ে হাসপাতালে তাদের বাবাকে দেখতে আসার জন্য কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু তারা কষ্ট সহ্য করতে পারবে না ভেবে তাদের আনা হয়নি। তাদের কান্নাকাটি থামাতে একজন আত্মীয় মোবাইল ফোনে সবুজের ছবি তুলে নিয়ে রাতে বাসায় তাদের দেখিয়েছিলেন। বাবার ছবি দেখে আঁতকে ওঠে লামিয়া ও রোহান। দুই ভাইবোন বাবার ওই চেহারা মানতে পারছে না। নানা প্রশ্ন করে তারা। তাদের বাবার চেহারা আবার আগের মতো হবে কিনা– এসব নিয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। 

রুশিদা জানান, তাঁর স্বামী ডেমরা রোডে রমজান পরিবহন নামের বাসের চালক। অবরোধ থাকায় তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন রুশিদা। পরদিন সমিতির কিস্তির টাকা জোগাড় করতে তিনি বের হন। যাওয়ার সময় স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, অবরোধের কারণে রাস্তায় কোনো ঝামেলা দেখলে তিনি বাস চালাবেন না। বাসায় ফিরে আসবেন। তবে কথা রাখতে পারেননি সবুজ। 
কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে রুশিদার। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। জামাই (স্বামী)-বউ কাজ করে যা আয় করি, তা শেষ হয়ে যায়। জমানো টাকা নেই যে তা দিয়ে চলব। রোববার ১ হাজার ৪৪৭ টাকার ওষুধ কিনেছি। আবার ওষুধ কিনতে হলে টাকা পাব কোথায়? এদিকে সপ্তাহে ১ হাজার ৫০০ টাকা সমিতির কিস্তি। সমিতি থেকে টাকা তুলে আমার স্বামী ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করেছিলেন আর বাকি টাকা সংসারে খরচ করেছিলাম। স্বামী হাসপাতালে, কিস্তি দেব কী করে?’ 

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আমি মানুষের বাড়ি কাজ করি। এখন স্বামীর সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। কতদিন স্বামী হাসপাতালে থাকব, জানি না। যাদের বাড়ি কাজ করি, তারা কতদিন ছুটি দেবে আমাকে? আমার কাজটাও হয়তো হারাতে হবে।’

চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারা সেই দুর্বৃত্তকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। খিলগাঁও থানার ওসি মনির হোসেন মোল্যা বলেন, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে জড়িতকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন