অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপায় খুঁজতে বিদেশি চাপ
.প্রতীকী ছবি
তাসনিম মহসিন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৯:২৯ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:৫১
এতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাওয়া ছিল, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। তবে নির্বাচনের দিন যতই দরজায় কড়া নাড়ছে, তারাও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। কূটনীতিকরা এখন শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নয়– নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, সহিংসতামুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক দেখতে চাইছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, এর ঘাটতিও দেখছেন তারা।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা নিয়ে চাপ আসছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপানসহ পশ্চিমা মিত্র– সবাই অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, সহিংসতামুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে একমত। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর তরফ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে সংলাপের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা মিত্ররা মনে করে, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি), মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করে। এ বিষয়টি ১৩ নভেম্বরের জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউর শুনানিতে তুলে ধরা হবে।
এদিকে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে কূটনীতিকদের কাছে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে তা শান্তিপূর্ণ করতে বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতার কথা সরকারের তরফ থেকে বলা হয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক করা নিয়ে পশ্চিমাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে সরকার। কূটনীতিকদের কাছে সরকার বলছে, নির্বাচনে কোনো দল অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, এটি একান্তই সে দলের সিদ্ধান্ত। সরকার মনে করে, জনগণ অংশগ্রহণ করলেই তা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের কৌশলগত সংলাপে লন্ডন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় বলে জানিয়েছে। তখন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যুক্তরাজ্য এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায়, যাতে সবাই অংশ নেয়। বাংলাদেশও এ ধরনের নির্বাচনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বলেছি, এ বিষয়ে আমাদের দ্বিমত নেই। অংশগ্রহণ নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছে, জনগণের অংশগ্রহণ, যা সরকার বা ইসি নিশ্চিত করতে পারে। তবে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, এটি তাদের নিজস্ব বিষয়।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে সরকার তার ব্যাখ্যা দিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সেটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রহণ করবে, নাকি করবে না– সেটি তাদের বিষয়। আমার মতে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যে নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, যে রাজনৈতিক দলের ভোটার রয়েছে, যে রাজনৈতিক দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, সে দলগুলো যদি মুক্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তাহলেই তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে।
গ্রহণযোগ্য বিকল্প নির্বাচনে অংশ নিলে তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এমন বিকল্প থাকতে হবে, যেখান থেকে জনগণ তার বেছে নেওয়ার অধিকার চর্চা করতে পারে।
গত রোববার ইইউর পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে বের করা জরুরি বলে জানানো হয়েছে। ইইউ পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা দপ্তরের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেল এক বার্তায় বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ভূমিকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এখনও নির্বাচনে সহায়ক পরিবেশ হয়নি। ফলে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সব পক্ষকে নিঃশর্ত সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।
এদিকে তপশিলের আগে আগে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন ঢাকার যুক্তরাজ্য হাইকমিশনার সারা কুক। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রতিটি বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের অবস্থান তুলে ধরেন।
আসছে নির্বাচন ঘিরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ভোট সহায়ক হিসেবে দেখছেন না কূটনীতিকরা। সহায়ক পরিবেশ না থাকার পেছনে একেবারে মৌলিক বিষয়গুলো সামনে এনেছেন কূটনীতিকরা। এর মধ্যে রয়েছে– ইসির সীমাবদ্ধতা, ইসির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর অনাস্থা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার শঙ্কা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ নিরসনে সংলাপের কোনো পরিবেশ না দেখা, নির্বাচন ঘিরে সংঘাত, বিরোধী মতের প্রতি সহিংসতা, নাগরিক সমাজের স্থান সংকুচিত হওয়া, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দলগুলো ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি প্রশাসনের সমান আচরণের অভাব, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার অভাব।
নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখনও বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনবার চিন্তা করতে হয়। এটিকে নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ বলা যায় না।
এ পরিস্থিতিতেও সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন পর্যন্ত কূটনীতিকদের সঙ্গে সব বৈঠকে সরকারের সব পর্যায় থেকে এ প্রতিশ্রুতির কথাই বলা হচ্ছে। আর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে– জানতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ভুয়া ভোটার বাতিল করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠন আইন করা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন বিষয় কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে কূটনীতিকদের মনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, মোটাদাগে এসব বিষয় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়েও ছিল। তবে কেন সেই নির্বাচনগুলো ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হলো।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় আগামী নির্বাচনে কী পরিবর্তন আসছে, যা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে সরকার বলছে– জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে সুবিধার বিষয়গুলো সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা ২০০৮ সালে করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১১টি নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে, যাতে ক্ষমতাসীনরাই জয় পেয়েছে এবং কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় আগামী নির্বাচন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। কারণ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে না।
তিনি বলেন, আর এটি সম্ভব হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার কারণে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবার সমান সুযোগ ছিল, এখন সেই সমতল ক্ষেত্র বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় পাবে– এ উপসংহারে সহজে আসা যায়। এ কারণে কূটনীতিকরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় কী পরিবর্তন হয়েছে– তা ধরতে পারছেন না, কারণ কোনো পরিবর্তনই হয়নি।