আচরণবিধি মানাতে গা-ছাড়া ভাব ইসির
.
মসিউর রহমান খান
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ০১:২৮
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের শোডাউনে নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলেও মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার সুযোগ নেই।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তপশিলের পর থেকে রাজনৈতিক দল ও সম্ভাব্য প্রার্থীরা আচরণবিধির আওতায়। আগের দুই নির্বাচনের মতোই এবার সবকিছু ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে– এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে তারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইসির পক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্লেষকদের মতে, দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত প্রশাসনের ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রধান উপায় আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর অবস্থান গ্রহণ। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে ইসি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সবার মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে পারে। শুরুতেই আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকানোর বিষয়ে শিথিল মনোভাব প্রদর্শন পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
গত ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেন। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ হবে। ওই ভাষণে তিনি প্রচারের সময়সীমা উল্লেখ করেছেন। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রচারের সুযোগ রয়েছে। এর আগে ও পরে যে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার আচরণবিধির লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ১৮ নভেম্বর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। গত তিন দিনে ৩ হাজার ১৯টি ফরম বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৯০টি। অনলাইনে ব্যবস্থা থাকার পরও ফরম ক্রয়ের সময় সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে শোডাউনের প্রতিযোগিতা চলছে। এতে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। রোববার কর্মী-সমর্থকের চাপে তিন দফায় চেষ্টা চালিয়েও কার্যালয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
ইসি কার্যালয়ের সচিব জাহাংগীর আলম এসব ঘটনাকে আচরণবিধির লঙ্ঘন মনে করলেও গতকাল সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র ইসিতে জমা না দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে প্রার্থী বলা যাবে না। আর প্রার্থী না হলে তাঁর ওপরে আইন প্রয়োগ করা কীভাবে সম্ভব? তিনি আরও বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নামানোর জন্য ইতোমধ্যে জনপ্রশাসনের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তারাই আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন। এর আগ পর্যন্ত রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এসব বিষয় দেখবেন। রাজশাহীতে সরকারি দলের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সমাবেশ বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে ইসি সচিব বলেন, ব্যবস্থা যে একদম নেওয়া হচ্ছে না, তা নয়। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে যে কোনো ঘটনার ব্যাপারে ইসি পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না।
এদিকে গতকাল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের দলীয় মনোনয়ন ফরম তোলার জন্য তাঁর নির্বাচনী এলাকা রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) থেকে নেতাকর্মী ঢাকা আনতে সিল্ক সিটি এক্সপ্রেস ট্রেনে আলাদা বগি ও স্পেশাল স্টপেজের ব্যবস্থা করা হয়। ওই বগি ও দুটি কেবিনে সকালে চারঘাট ও বাঘা উপজেলার দেড় শতাধিক নেতাকর্মী সরদহ স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এই স্টেশনে ট্রেনটি থামার কথা নয়। তপশিল ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রীর এই ক্ষমতা প্রদর্শনে হতবাক হয়েছেন দলীয় অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীও। তারা বলছেন, প্রতিমন্ত্রী প্রভাব খাটিয়ে এমনটি করেছেন। এতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে।
এসব বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সমকালকে বলেন, তপশিল ঘোষণার পর থেকেই আচরণবিধির আওতায় পড়ে যাচ্ছেন সবাই। শুধু দলীয় কার্যালয় ঘিরে মিছিল-সমাবেশ নয়; তপশিলের পর মন্ত্রীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগের দুই নির্বাচনের মতো এবারও সবকিছু ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের প্রচার শুরুর দিন না এলেও পোস্টার-ব্যানার লাগানো হচ্ছে বা দল বেঁধে মিছিল করে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। এসব অবৈধ। আইনানুযায়ী পোস্টার হতে হবে সাদাকালো। তবে এখন বেশির ভাগ পোস্টারে প্রার্থিতাপ্রত্যাশী ছাড়াও আরও অনেকের ছবি থাকে। পোস্টারগুলোও রংবেরঙের হয়ে থাকে। পোস্টার দেয়ালে, গাড়িতে, এমনকি গাছেও লাগানো নিষেধ। শুধু রাস্তার ওপরে দড়ি দিয়ে পোস্টার ঝোলানো যাবে।
নির্বাচনী আইনানুযায়ী, যত্রতত্র ক্যাম্পেইন অফিস বানানো নিষেধ। নিয়ম হলো একটি পৌরসভায় প্রতি ওয়ার্ডে একটি ক্যাম্পেইন অফিস থাকতে পারবে। সেই কার্যালয়ে টেলিভিশন রাখা নিষেধ; মাইক লাগানো যাবে না। দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রার্থীরা প্রচার চালাতে পারবেন। একটি ওয়ার্ডে তিনটির বেশি মাইক ব্যবহার নিষেধ। ভোট পাওয়ার জন্য লোকজনকে দাওয়াত দেওয়া, খাওয়ানো বা উপহার দেওয়া নিষেধ। নির্ধারিত সময়ের আগে প্রচার শুরু করা যাবে না। এই সময়ে কোনো মন্ত্রী তাঁর এলাকায় গেলে প্রটোকল পাবেন না। এই সময় তারা কোনো উন্নয়নমূলক কাজ উদ্বোধন করতে পারবেন না, যা প্রচার বলে গণ্য হতে পারে। শুধু চলতি প্রকল্প বাদে এই সময় কোনো অনুদান দেওয়ারও অনুমোদন নেই। নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না। কোনো মন্দির, মসজিদ বা গির্জায় ভোট চাইতে পারবেন না প্রার্থীরা।
আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলে জরিমানা ও জেল– দু’ধরনের শাস্তির ব্যবস্থাই রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে এই শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কমিশন তদন্তের জন্য কমিটি তৈরি করে, যাতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছয় মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। এর ওপরে হলে আদালতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে গত তিন দিন মনোনয়ন ফরম বিক্রির সময় দেখা গেছে, কেউ এসেছেন সুসজ্জিত গাড়ি নিয়ে, কেউবা ব্যান্ড দল সহকারে। নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি মাইকে গান বাজানো হচ্ছে। ব্যানার-ফেস্টুন আর মিছিল নিয়ে আসা রংবেরঙের পোশাকে সজ্জিত নেতাকর্মীর স্লোগানে মুখর ছিল আশপাশ এলাকা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে কর্মী-সমর্থক নিয়ে এসে শোডাউন করেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।
ভোটের মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে ৭ লাখ সদস্য
নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৩২২ জন সদস্য মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন। এর বাইরে নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে কিনা– ইসি সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন বিষয়ে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে মূলত এসব বাহিনীর বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে ইসির কাছে পৃথক চাহিদা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তারা কিছু অর্থ আগামও চেয়েছে। তবে চাহিদার বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি।
বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সম্ভাব্য বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা জনবলের ভিত্তিতে চাহিদার বিষয় জানিয়েছেন। তবে এটি চূড়ান্ত নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত হার হিসাবে কত সংখ্যক সদস্য নিযুক্ত হবেন, সে অনুযায়ী অর্থ প্রদান করা হবে।
তিনি জানান, তারা কিছু অগ্রিম বরাদ্দ চেয়েছেন। বরাদ্দপ্রাপ্তি সাপেক্ষে তার কতটুকু আমরা দিতে পারব, সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি। কত চেয়েছে– জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, বিষয়টি যেহেতু চূড়ান্ত নয়, কাজেই বলতে চাচ্ছি না। তবে ভোটের মাঠে আনসার সদস্য ৫ লাখ ১৬ হাজার, পুলিশ ও র্যাব ১ লাখ ৮২ হাজার ৯১, কোস্টগার্ড ২ হাজার ৩৫৫, বিজিবির ৪৬ হাজার ৮৭৬ সদস্য থাকবেন।
জানা গেছে, পদমর্যাদা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভাতা পেয়ে থাকেন। একজন পুলিশের সর্বনিম্ন ভাতা ৫৩৬ টাকা, সর্বোচ্চ ১২০০। র্যাব সদস্যরাও একই পরিমাণ পেয়ে থাকেন। বিজিবি সদস্যরা সর্বনিম্ন ৪০০, সর্বোচ্চ ১২২৫ টাকা ভাতা পাবেন। কোস্টগার্ড সর্বনিম্ন ৬৩৭ টাকা, সর্বোচ্চ ১৮০০; আনসার সদস্যরা সর্বনিম্ন ১ হাজার, সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০ টাকা ভাতা পান।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগেই ইসির কাছে একটি খসড়া চাহিদা দিয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ ৪৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা, আনসার ও ভিডিপি ৩৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকা, র্যাব ৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং কোস্টগার্ড ৭৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা চেয়েছে।