ঢাকা বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনতে শোডাউন

আচরণবিধিতে থাকলেও লঙ্ঘন বলছে না ইসি 

৪৪ বিদেশি পর্যবেক্ষকের ১১ জনই উগান্ডার

আচরণবিধিতে থাকলেও লঙ্ঘন বলছে না ইসি 

নির্বাচন ভবন

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:১১

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের শোডাউনকে আচরণবিধি লঙ্ঘন মনে করছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এ সংস্থাটি বলছে, দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে শোডাউন রাজনৈতিক কার্যক্রম। এর ওপরে হস্তক্ষেপ ইসির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, আচরণবিধিতে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ বলতে তপশিল ঘোষণা থেকে ফল গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত সময়কে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে।

এ ব্যাপারে কমিশনের একাধিক সদস্য, ইসি কার্যালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ (আইন) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিশনের একাধিক সদস্য বলেছেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। কারণ এখন পর্যন্ত কে প্রার্থী, তা নিশ্চিত নয়।

অথচ সংসদ নির্বাচনের জন্য ইসির নিজের তৈরি আচরণবিধির শিরোনামেই বলে দেওয়া রয়েছে, ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমলে ২০০৮ সালের প্রণীত এই বিধিমালা ২০১৪ সালে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে সংশোধন করা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় নির্বাচন-পূর্ব সময় বলতে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।

আচরণবিধির ৮ ধারায় বলা আছে, ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা তাঁর মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তাদের পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি– (ক) কোন ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল, নৌযান, ট্রেন বা অন্য কোন যান্ত্রিক যানবাহনসহ মিছিল কিংবা মশাল মিছিল বের করতে পারবে না বা কোনরূপ শোডাউন করতে পারবে না। (খ) মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোন প্রকার মিছিল বা শোডাউন করতে পারবেন না।’ 

এই বিধিমালার ১২ ধারায় স্পষ্টভাবে প্রচারের সময় সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বা তাঁর মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের তিন সপ্তাহ সময়ের আগে কোন প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারবেন না।’

গত ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার সময়েও আগামী ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে ভোট গ্রহণের আগের ৪৮ ঘণ্টা বা ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত প্রচারের সুযোগ রয়েছে বলে সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, ইসির নিজের তৈরি আচরণবিধি নিজেরাই মানতে চাইছে না– এটা চরম দুঃখজনক এবং জাতির কাছে বিভ্রান্তিকর। অনেক বিষয়েই তারা জোর খাটাতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, নিজের তৈরি আইন যদি নিজেই প্রয়োগ না করে, তাহলে কমিশন সদস্যদের কাজটা কী। কমিশনের এমন আচরণকে তিনি বিশেষ কারও এজেন্ডা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।

আচরণ বিধিমালার ১৭ ধারায় বলা আছে, এই বিধিমালার যে কোনো বিধানের লঙ্ঘন ‘নির্বাচন-পূর্ব অনিয়ম’ হিসেবে গণ্য হবে। পাশাপাশি ১৮ ধারায় বলা আছে, কারও পক্ষে কোনো ব্যক্তি বা সরাসরি প্রার্থী এই বিধি লঙ্ঘন করলে তার শাস্তি হবে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড। কোনো রাজনৈতিক দল এই বিধিমালা লঙ্ঘন করলে তার শাস্তি ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড।

তিন মন্ত্রণালয়কে চিঠি

সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে প্রকল্পের অর্থছাড় এবং কোনো অনুদান না দিতে সরকারের তিন মন্ত্রণালয় ও একটি সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে ইসি। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে ইসির পক্ষ থেকে আলাদা চিঠি পাঠানো হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচন-পূর্ব সময় (তপশিল ঘোষণার দিন থেকে ফল গেজেটে প্রকাশ) পর্যন্ত কোনো সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো অনুদান ঘোষণা বা বরাদ্দ বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না। এ বিধান লঙ্ঘন দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে এ সময়ে নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রার্থী সিটি করপোরেশন/পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তি তথা অফিস, যানবাহন, মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ওয়াকিটকি বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না। অনুদান বা ত্রাণ বিতরণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম বা উন্নয়নমূলক কোনো প্রকল্প অনুমোদন না করার কথা চিঠিতে বলা হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় নতুন কোনো অনুদান বা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নেওয়া যাবে না। তবে যেসব ত্রাণ কার্যক্রম আগে থেকে চলছে তা চালু থাকবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনী এলাকায় নতুন ভিজিডি কার্ড ইস্যুসহ নতুন কোনো অনুদান বা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নেওয়া যাবে না। তবে যেসব ত্রাণ কার্যক্রম আগে থেকে চলছে তা অব্যাহত থাকবে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে পাঠানো চিঠিতেও একই কথা বলা হয়।

বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য সময় বাড়ল

নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের জন্য আবেদনের সময় বাড়িয়েছে ইসি। নতুন করে আগামী ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন ইসি কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম দফায় আবেদনের নির্ধারিত সময় শেষ হয়। এতে ১২ দেশের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক এবং চারটি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আগ্রহের কথা জানিয়ে আবেদন করে।

গতকাল ইসি কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অশোক কুমার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি সংস্থা সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে। কমিশন ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ে আবেদনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে দাবি করে অতিরিক্ত সচিব বলেন, এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

ইসির দেওয়া তথ্যানুযায়ী নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ১২ দেশ থেকে ৪৪ পর্যবেক্ষক আসবেন। এর মধ্যে উগান্ডা থেকেই আসছেন ১১ জন। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন, ইতালির একজন, আইরিশ একজন, স্লোভাক একজন, ব্রিটিশ একজন, ফ্রান্সের একজন, উগান্ডার ১১ জন, জার্মানির দু’জন, জাপানিজ একজন, সুইডিশ একজন, নিউজ এজেন্সি এএফপি থেকে ১২ জন, ভারতীয় একজন, সাউথ এশিয়ান ফোরাম থেকে চারজন, ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে একজন, নিউ দিল্লি টেলিভিশন থেকে দু’জন আবেদন করেছেন। তবে ইসির এ তালিকায় পর্যবেক্ষকদের বাইরে বিদেশি সাংবাদিকদের পাশাপাশি ভিনদেশি সাধারণ নাগরিকদের নামও রয়েছে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে কারাবন্দি, বিদেশিরাও ভোট দিতে পারবেন বলে ইসির তরফ থেকে জানানো হয়। এ জন্য তপশিল ঘোষণার ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে নিজ এলাকার রিটার্নিং অফিসারের কাছে ভোটার নম্বর উল্লেখ করে জানাতে বলা হয়েছে।

ভোটার তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা কারাগারে কিংবা বিদেশে থাকলেও পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জেলাখানায় বন্দি, নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্ট এবং বিদেশে অবস্থানকারীরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।

এনআইডি সংশোধন কার্যক্রম চালু থাকবে

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন ও সংশোধন-সংক্রান্ত কার্যক্রম চালু থাকবে বলে মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। তপশিল হয়ে যাওয়ায় মাঠ কর্মকর্তাদের অনেকেই নানা অজুহাতে নতুন করে নিবন্ধন, এনআইডি সংশোধন কার্যক্রমে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিষয়টি কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্র এখন অপরিহার্য, তাই এ সেবা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা বা দুর্ভোগে ফেলা যাবে না।

আরও পড়ুন