ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

বেশি সিলেবাসের চাপে এইচএসসিতে কম পাস

বেশি সিলেবাসের চাপে  এইচএসসিতে কম পাস

এইচএসসি পরীক্ষার ভালো ফলে উচ্ছ্বাস। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ -সমকাল

 সাব্বির নেওয়াজ

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৩ | ০১:০১ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৩ | ১২:৩৪

উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরিয়েছেন দেশের ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ তরুণ-তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হাতছানি এখন তাদের সামনে। উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়াতে উন্মুখ তারা। তবে পাস করতে পারেননি ২ লাখ ৯০ হাজার ৬৩ জন। তাদের কারও এক বিষয়, কারও একাধিক বিষয়ে ফল খারাপ হওয়ায় ধাক্কা লেগেছে সার্বিক ফলে। 

এবার উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষায় কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি ও উচ্চতর গণিতের প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল। এতে পাসের হার কমেছে বলে মনে করেন অনেকে। পরীক্ষা শুরুর আগে কয়েকটি জেলায় বন্যা এবং শুরুর পূর্বমুহূর্তে উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কমপক্ষে তিনটি শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাসে বইখাতা ভেসে যাওয়ায় পড়ালেখা বিঘ্নিত হয়েছে এসব এলাকার পরীক্ষার্থীদের। এরও প্রভাব পড়েছে পাসের হারে। 

তবে পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে আগের বারের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে। গতবারের তুলনায় জিপিএ ৫ অর্ধেকে নেমেছে। ইংরেজিতে সব বোর্ডের ফলই নিম্নমুখী। 
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সমকালকে বলেন, গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে উচ্চ মাধ্যমিকে এবার ফল খারাপ হয়েছে। গত বছর সিলেবাস কমিয়ে অর্ধেক নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। তখন সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের সুবিধাও পেয়েছিল পরীক্ষার্থীরা। এবার পূর্ণ নম্বরে, পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তাই ২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলের সঙ্গে তুলনা করতে হবে এবারের ফল। এতে দেখা যাবে, এবারের ফল বরং ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, সব বোর্ডেই এবার ইংরেজির ফল কিছুটা খারাপ।

সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রমা বিজয় সরকার সমকালকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘকাল আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে পুরো পরীক্ষা নিতে পারিনি। এ বছর পূর্ণ সিলেবাসে, পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষা নিতে পেরেছি। এটাই আমাদের বড় অর্জন। করোনার কারণে ২০২১ সালে মাত্র তিন পত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ২০২২ সালে সব পত্রে মাত্র ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। তখন আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এবার পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচি অনুযায়ী একটি ছাড়া সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

পাস-ফেলের নিয়ামক ইংরেজি
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারও পাস-ফেলের নিয়ামত হয়েছে ইংরেজি। গত বছরের চেয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডে এবার ৩৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী ইংরেজিতে কম পাস করেছেন। এই বোর্ডে এ বিষয়ে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৩৬। তাই সার্বিক পাসের হারে সবচেয়ে পিছিয়ে এবার এই বোর্ড। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হারে সবাইকে পেছন ফেলেছে বরিশাল বোর্ড। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৮৬ দশমিক ০১। এ ছাড়া ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৮৩, রাজশাহীতে ৮৩ দশমিক ১৮, কুমিল্লায় ৮১ দশমিক ৯৮, চট্টগ্রামে ৮৮ দশমিক ৯১, সিলেটে ৮২ দশমিক ১৯, দিনাজপুরে ৮২ দশমিক ৮০, ময়মনসিংহে ৭৫ দশমিক ৩৮, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৯৬ ভাগ এবং কারিগরি বোর্ডে ৯৭ দশমিক ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। 

শিক্ষক, অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যাচটি করোনাকালের পড়াশোনার দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাচ। নবম-দশম শ্রেণি থেকেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০২১ সালে তারা অতিসংক্ষিপ্ত সিলেবাসে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন।

দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক স ম আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, এই বোর্ডে ফল ভালোই হয়েছে। দু-এক বছরের মধ্যে তুলনা করলে হবে না। করোনার আগের ফলের সঙ্গে তুলনা করলে ভালো হয়েছে। ইংরেজিতে মানবিকের শিক্ষার্থীরা সাধারণত একটু খারাপ করে। তবে সার্বিকভাবে ফল ভালোই মনে হয়েছে।

বিজ্ঞান শিক্ষার্থী ও ছাত্রীদের সাফল্য নজরকাড়া
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভাগভিত্তিক ফলে এ বছর বেশ এগিয়ে আছেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে অনেক পেছনে ফেলেছেন তারা মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের। এদিকে সাফল্যের যেন নতুন নিশান উড়িয়েছেন ছাত্রীরা। সব দিক থেকে তারাই এগিয়ে। এবার পাস করা মোট ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৫ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি। ছাত্রীদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ছাত্রদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রীর চেয়ে বেশিসংখ্যক ছাত্র অংশ নিয়েছিলেন। 

বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আ ক ম বাহারুল আলম সমকালকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করার ক্ষেত্রে অভিভাবকের অবদান অনেক বেশি। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠদানের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এর বিপরীতে অভিভাবকরা সন্তানের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন। তিনি মনে করেন, বরিশাল বোর্ডের শিক্ষার্থীরা ভালো করার পেছনে অভিভাবকদের সচেতনতাই মূল ভূমিকা রেখেছে। এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায়ও বরিশাল বোর্ড সারাদেশে প্রথম হয়েছিল।

এবারের ফলের চিত্র তুলে ধরে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহসান হাবীব বলেন, অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় যশোর বোর্ডর ফল খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে ইংরেজি পরীক্ষায় ৩৭ শতাংশ এবং উচ্চতর গণিতে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হয়েছে। এর প্রভাব সার্বিক ফলের ওপর পড়েছে।

তিনি বলেন, যশোর বোর্ডের শিক্ষার্থী অন্য বোর্ডের প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষায় ইংরেজি প্রশ্নপত্র জটিল হয়েছে। বিষয়টি তারা আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সভায় উত্থাপন করবেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ফল ভালো করার জন্য বোর্ডের পক্ষ থকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান গাজী হাসান কামাল সমকালকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে এইচএসসির ফল মূল্যায়ন করলে এবারের ফল গড় ফলাফল। মাঝখানে অটো পাস এবং কম সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ার কারণে ফল কিছুটা ভালো ছিল। এবারের ফল প্রকৃত চিত্র। ময়মনসিংহ ও যশোর বোর্ডে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা পদার্থবিদ্যায় কিছুটা খারাপ করেছে। তবে অনেকে ইংরেজিতে ফেল করেছে।  ইংরেজিতে বেশি ফেল করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন,  এখন যারা এইচএসসি পাস করেছে, তারা ২০২১ সালে এসএসসি পাস করেছিল। তারা কম সিলেবাসে তখন পরীক্ষা দিয়েছিল।  উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসের ব্যাপকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা কম ছিল। প্রশ্নও একটু কঠিন হয়েছিল।

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুস্তফা কামরুল আখতার বলেন, ‘এবারে পাসের হার গতবারের তুলনায় কম। জিপিএ ৫ প্রাপ্তির হারও গতবারের তুলনায় কম। তবে পাসের হার এবং জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে ছাত্রীরা এগিয়ে আছে।’

আরও পড়ুন

×