ফল বিশ্নেষণ
সাবজেক্ট ম্যাপিং

ছবি: ফাইল
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:৫৪
কোনো পরীক্ষা হয়নি, আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার ফল গড় করে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হলো। তবু বড় ধরনের হেরফের। আগের দুই পরীক্ষাতে সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ নেই, এমন কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী এবার জিপিএ ৫ পেয়েছেন। আবার আগের দুই পরীক্ষায়ই জিপিএ ৫ পেয়েও এবার এ প্রাপ্তি থেকে ছিটকে পড়েছেন ৩৯৬ জন। সাধারণ অভিভাবকদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন এমন হলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের 'সাবজেক্ট ম্যাপিং'য়ের কারণেই এমনটি ঘটেছে। ফলে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি। আবার প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির যোগ বেশি ঘটেছে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে। আগের দুটি পরীক্ষার চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ হয়ে ৮০ থেকে ৮৫ নম্বরের কাছাকাছি (মার্জিনাল লাইন) থাকা শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন। এবার চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ না হওয়ার কারণে এই শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি।
জানা গেছে, পরীক্ষা ছাড়াই আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করার জন্য এবার একটি নীতিমালা করা হয়। ফল প্রকাশের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠন করা আট সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি এই নীতিমালা তৈরি করে। এ নীতিমালা অনুসারে করা হয় 'সাবজেক্ট ম্যাপিং'। এই সাবজেক্ট ম্যাপিং এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিপুল সংখ্যকের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। অনেকে অতি মূল্যায়িতও হয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের বঞ্চিত মনে করছেন।
দেখা গেছে, আগের দুই পাবলিক পরীক্ষায় (জেএসসি/জেডিসি ও এসএসসি) জিপিএ ৫ থাকলেও অনেকে এবার জিপিএ ৫ বঞ্চিত হয়েছেন। সারাদেশে এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৯৬ জন।
আবার উল্টোটিও ঘটেছে। আগের দুই পরীক্ষা অর্থাৎ জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না পেলেও এবারের মূল্যায়নে ১৭ হাজার ৪৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছেন।
'কেন এমন হলো'- জানতে চাইলে গতকাল শনিবার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, গত বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরির জন্য সাবজেক্ট ম্যাপিং করায় জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেলেও এবার ৩৯৬ জন জিপিএ ৫ পায়নি। তিনি বলেন, সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে জিপিএ ৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। যখন ম্যাপিং করা হয়েছে, তখন জিপিএ ৫-এর জন্য যে নম্বর দরকার ছিল, তা তারা পায়নি। আবার বিষয়ভিত্তিক ম্যাপিং করায় অনেকে আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না পেলেও এবার সেটি অর্জন করেছে। ফল বিশ্নেষণে দেখা গেছে, জিপিএ ৫ না পাওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীই বেশি।
জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না পেলেও এবারের ফলাফলে ১৭ হাজার ৪৩ জন জিপিএ ৫ পেয়েছেন বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি জানান, জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেলেও ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৩৭১ জন, ২০১৮ সালে ৫২ হাজার ৬৩৪ জন এবং ২০১৯ সালে ৪৫ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাননি।
জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ না পেলেও ২০১৭ সালে ছয় হাজার ৯৭৬ জন, ২০১৮ সালে চার হাজার ১৫৭ জন এবং ২০১৯ সালে আট হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিল বলেও জানান তিনি।
যেভাবে হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাপিং: মহামারিকালে পরীক্ষা ছাড়াই আগের পরীক্ষার ভিত্তিতে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি বব্যহার করা হয়েছে।
কীভাবে এই সাবজেক্ট ম্যাপিং করা হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি তা জানিয়েছেন। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটিও ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী জানান, জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ৭৫ শতাংশ বিষয়ভিত্তিক নম্বর বিবেচনা করে গতবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের নম্বরের ৭৫ শতাংশ বিবেচনা করে এইচএসসিতে আবশ্যিক বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞান বিভাগের ক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিত/জীববিজ্ঞান বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে যথাক্রমে এইচএসসির পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিত/জীববিজ্ঞান বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার গণিত ও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বরের ২৫ শতাংশ ও এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক তিনটি সমগোত্রীয় বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে যথাক্রমে এইচএসসির ব্যবসায় শিক্ষা গ্রুপের তিনটি সমগোত্রীয় বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া মানবিক ও অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার গণিত ও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বরের ২৫ শতাংশ এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক পরপর তিনটি বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে যথাক্রমে এইচএসসির মানবিক ও অন্যান্য গ্রুপের তিনটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
গ্রুপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জেএসসি ও সমমান পরীক্ষার গণিত ও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বরের ২৫ শতাংশ ও এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক পর পর তিনটি বিষয়ের ৭৫ শতাংশ নম্বর বিবেচনা করে যথাক্রমে এইচএসসির মানবিক ও অন্যান্য গ্রুপের তিনটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে বলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি জানিয়েছে।
জিপিএ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। আংশিক বিষয়ের পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অকৃতকার্য বিষয়ের নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রেও ওপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে ফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট মঞ্জুরুল কবীর জানান, আগের দুই পরীক্ষায় যারা চতুর্থ বিষয়ের জিপিএ মিলিয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ এবার পদ্ধতিতে মূল্যায়নের ফলে পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাননি।
ফল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন: গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সমকালকে বলেন, ফল নিয়ে নানা মতামত, অনুযোগ থাকতেই পারে। তবে আমি মনে করি, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পরবর্তী উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এটা খুব দরকার ছিল। কোনো অবস্থাতেই এই পরীক্ষা আয়োজনের কোনো সুযোগ ছিল না। ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ১৪ লাখ অভিভাবক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষক, কর্মকর্তা মিলে বড় ধরনের লোকসমাগম হতো। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বহুগুণে বাড়ত। তিনি বলেন, সবাই পাস করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর বহু আসন খালি পড়ে থাকত। শিক্ষার্থীরা এবার এসব আসনে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে পারে। যারা কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি, তাদের বলব, মন খারাপ না করে পরবর্তী উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, মার্জিনাল লাইনে নানা বিষয়ে ৮০-৮২ পেয়েও অনেকে আগের দুটি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছিল। তারা হয়তো এবারও জিপিএ ৫ আশা করেছিল। কেউ হয়তো ধর্মে ৮০-৯০ নম্বর পেয়েছিল। তবে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের কারণে যেসব বিষয় আমরা আমলে নিয়েছি, সে হয়তো তা পায়নি। তাই জিপিএ ৫ পায়নি।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন বলেন, আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েও যশোর বোর্ড থেকে এবার ৯৪ জন জিপিএ ৫ পায়নি। হয়তো তারা চতুর্থ বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিল। এতে অনেকের জিপিএ ৫ ছুটে গেছে। আবার অনেকে শুধু এক বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম ফিলআপ করেছিল। তবে নতুন নীতিমালায় তার আগের দুটি পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করায় সে আর সর্বোচ্চ ফল পায়নি। তিনি আরও বলেন, এবারের ফলকে অটোপাস কিছুতেই বলা যাবে না। কারণ তারা আগের দুটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল এবং সেই পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই এই ফল।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, এই ফলের কারণে শিক্ষার্থীর জীবন থেকে একটি বছর বেঁচে গেল। এটাই বড় কথা।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রমা বিজয় সরকার বলেন, পরীক্ষার্থীরা টানা দুটি বছর পড়েছে। পরীক্ষারও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়েছিল। মহামারির কারণে পরীক্ষা হতে পারেনি। তাই তারা না শিখে পাস করেনি। তারা উচ্চশিক্ষায়ও তাদের মেধার যথাযথ পরিচয় দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
- বিষয় :
- সাবজেক্ট ম্যাপিং
- ফল বিশ্নেষণ