- বাংলাদেশ
- বায়ান্ন, একাত্তরের অঙ্গীকার যেন ভুলে না যাই
একুশের ৬৯ বছর
বায়ান্ন, একাত্তরের অঙ্গীকার যেন ভুলে না যাই

অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসের বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ইতিহাসের অনন্য দিন। মাতৃভাষা বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করার সেই ঐতিহাসিক মাসের সূচনা হলো আজ। করোনা মহামারি দুর্যোগে প্রায় গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত। করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেকটা সফল হলেও, এর বিরূপ প্রভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত নই। এর অভিঘাত লেগেছে নানা দিকেই। একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে আমাদের নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ব্যাপকভাবে যে মেলাটি একুশে বইমেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই মেলা যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। করোনার কারণে প্রতি বছরের মতো এবার ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই এই মেলা শুরু হচ্ছে না। মহামারির কারণে পিছিয়ে যাওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন হবে ১৮ মার্চ। বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগের মতোই প্রকাশ্যে এই মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে করোনা জয়ের লক্ষ্যে টিকা কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তার পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি আমলে রেখেই বইমেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন মনে করি।
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই সংবাদমাধ্যমগুলোও আমাদের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নানারকম আয়োজন করে থাকে। একুশের প্রেক্ষাপট অনেক বিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাঙালির জাতীয় জীবনে বাঁক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই রচিত হয় আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মহান অধ্যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্ব। সচেতন মানুষ মাত্রই এসব জানা। এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
তার পরও নতুন প্রজন্মের এসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে আরও ব্যাপক জানার প্রয়োজন রয়েছে বিধায় এর আলোচনা-ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ চলমান রাখা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের পরই এ আন্দোলন হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ভাষার দাবিতে এ দেশের মানুষ আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। এর আগে পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিনও উর্দুর পক্ষে সাফাই গাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করলেন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবীরা।
এ নিয়ে প্রথমে লিখলেন আবদুল হক। এরপর ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ফখরুল আহমদ প্রমুখ। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। এরপর গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ। ১১ মার্চ ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্মঘট পালন করে। আমি তখন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে আইএসসির ছাত্র। ভাষার দাবিতে সেখানে যে মিছিল হয়, সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। এরপর আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হই ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্র-ছাত্রীরা। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছিল বলেই আন্দোলনটি সর্বাত্মক রূপ পেয়েছিল; ছড়িয়ে পড়েছিল এই ভূখণ্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে শিক্ষার্থীরা মিছিল করলে পুলিশ গুলি করে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের মানুষ আরও বেশি আন্দোলনমুখী হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে তখনই সরকার স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি আসে পরে। স্মরণযোগ্য, ওই আন্দোলনের ফলেই শিল্প-সাহিত্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর যেসব গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা রচনার পাশাপাশি আরও যে লেখালেখি হলো, তাতে বাঙালির আত্ম-অনুসন্ধানের চেষ্টা ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির পর কুমিল্লায় ১৯৫২ সালে সাহিত্য সম্মেলন হলো। সেখানে 'নবান্ন'র মতো নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় হলো সাহিত্য সম্মেলন। ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে। এসবই ছিল ভাষা আন্দোলনের তাৎক্ষণিক অর্জন। আবারও বলি, ভাষা আন্দোলনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক চেতনা এই দুই ঘটনার কেন্দ্রে ছিল, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজে আমরা এর যথাযথ বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারলাম না কেন- আজকের বাস্তবতায় এও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবির মূলকথা ছিল রাজভাষা ও রাজসংস্কৃতির স্থলে জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা কি হয়েছে? এখনও আমরা রাজভাষা ও সংস্কৃতিই অনেক ক্ষেত্রে লালন করে চলেছি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয় ও ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩ রাষ্ট্রে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার এটি একটি বড় ধাপ।
কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে কতটা কী করতে পেরেছি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বটে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলার প্রচলনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটুকু? উত্তরটা প্রীতিকর নয়। ভাষা শুধু সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমই নয়; ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরও বাহন। শিল্পকর্মসহ সবক্ষেত্রে অগ্রগতিরও ধারক। আমাদের সরকার ও সমাজ ভাষা আন্দোলনের চেতনার আলোকে অনেক দায়িত্বই পালন করতে পারেনি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গোলমেলে। কথা ছিল একমুখী শিক্ষা হবে। কিন্তু হলো না আজও। অর্থাৎ একুশকে আমরা মর্মে নিতে পারিনি। আমরা রাষ্ট্র বদল করলাম, কিন্তু সমাজ বদলের কথা ভাবলাম না। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী বাংলার বিরোধিতা করেছিল বলেই আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এখনও সমাজে-রাষ্ট্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, অবিচার, বৈষম্য জিইয়ে আছে। অপরাধের বিস্তৃতি ঘটছে। ইতিহাস অনেক কিছুই ধরে রাখে না। ছোটখাটো অনেক কিছুর সেখানে ঠাঁইও হয় না। আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকরা কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা অহরহ বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- বিদ্যমান বাস্তবতা কী সাক্ষ্য দেয়?
কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে ও সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, বৈষম্য দূরীকরণে এবং একমুখী শিক্ষার বিষয়টিকে অবশ্যই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এসবের বাস্তবায়নে কাজের কাজ হোক। সময় অনেক বয়ে গেছে। বায়ান্ন, একাত্তর পর্বের যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ছিল, তা যেন আমরা ভুলে না যাই। সময় বদলায়, প্রেক্ষিতে বদল দেখা দেয়; কিন্তু একুশের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না- এও স্মরণে যেন থাকে। ফেব্রুয়ারি আবার ফিরে এসেছে। অতীতের স্মৃতি হিসেবে নয় কেবল, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি হিসেবেও। একুশের শিক্ষাটা কি? শিক্ষা এই যে, সমষ্টির পক্ষে কোনো বিজয়ই অসম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, বায়ান্নর আন্দোলনের সূত্র ধরে অবশ্যই শ্রেণি বিভাজন দূর করার যে অতিশয় প্রয়োজনীয় কাজটি এখনও বাকি রয়ে গেছে, সেটিকেই সম্ভব করে তুলতে হবে। শ্রেণিবিভাজন দূর করতে না পারলে অনেক কিছুই অধরা থেকে যাবে। আমরা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা নিয়েছি ইউরোপ থেকে। তারা জাতীয় ভাষাকে জীবিকার ভাষা হিসেবে নিয়েছে। এসব বিষয় আমলযোগ্য থাকুক।
লেখক: ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
মন্তব্য করুন