- বাংলাদেশ
- করোনায়ও প্রতিবন্ধীর ভাতা আত্মসাৎ, ঘুষ নিয়ে সেবা: টিআইবির গবেষণা
করোনায়ও প্রতিবন্ধীর ভাতা আত্মসাৎ, ঘুষ নিয়ে সেবা: টিআইবির গবেষণা

করোনাভাইরাস মহামারির সময়েও প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে অনিয়ম হয়েছে। এ সময়ে প্রতিবন্ধীদের ভাতা আত্মসাতেরও ঘটনা ঘটেছে। ভাতা পেতে পদে পদে ঘুষ দিতে হয়েছে। প্রতিবন্ধী নয় এমন ব্যক্তিদের ভাতা কার্ড দিতে সংসদ সদস্যরাও তদবির করেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে সমাজসেবা কার্যালয়ের কার্যক্রমেও গাফিলতির চিত্র ধরা পড়েছে।
বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে 'উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিবন্ধিতা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে টিআইবি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার (গবেষণা ও পলিসি) ফারহানা রহমান।
এতে বলা হয়, সরকারি হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং তার সহকারীদের একাংশের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিকাংশ জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হয়রানির শিকার হয়েছেন। সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্যভান্ডারে নাম অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ২০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। প্রকৃত প্রতিবন্ধী না হলেও স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের একাংশ তাদের আত্মীয় ও পরিচিতজনদের সুবর্ণ কার্ড (প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড) দেওয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে তদবির করেছেন। এ কার্ড করার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে গেলে নাজেহাল হতে হয় বলেও অভিযোগ করেছেন কোনো কোনো সেবাগ্রহীতা। অতিদরিদ্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকেও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে সুবর্ণ কার্ডের জন্য এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, মাঠপর্যায়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার ওপর। প্রতিবেদন অনুসারে ভাতা গ্রহণে সময়ক্ষেপণের শিকার হয়েছেন ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যক্তি। স্বজনপ্রীতির ঘটনা ঘটেছে ১১ শতাংশ। প্রতারণার শিকার হয়েছেন ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের ভাতার অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ঘুষ দাবি করা হয়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে যে নতুন দুই লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতার আওতায় এসেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের ভাতার অর্থের অংশবিশেষ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে এসেছে গবেষণায়। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশ অর্থ আত্মসাতে জড়িত। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ভাতার প্রথম কিস্তির ২৪ থেকে ৬৭ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে অনেক অযোগ্য এনজিও অনুদান পেয়ে থাকে। এসব এনজিওর অধিকাংশ অঙ্গীকারকৃত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মতো সব সেবা নিতে অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ সব ক্ষেত্রেই তারা কমবেশি দুর্নীতির শিকার হন। উপবৃত্তির তালিকাভুক্তি, বইপ্রাপ্তি, ভর্তি-পুনঃভর্তিতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১১ দশমিক ৩ শতাংশ, ঘুষ দিতে হয়েছে ৮ শতাংশকে এবং গড় ঘুষ দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা। স্বাস্থ্যসেবার টিকিট কেনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শয্যা, হুইলচেয়ার ব্যবহার ও ওষুধ কেনায় দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার, ঘুষের শিকার হয়েছেন ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গড় ঘুষ দিয়েছেন ২৩৬ টাকা। বিভিন্ন ধরনের সনদ ও প্রত্যয়নপত্র ভাতা ও সালিশ গ্রহণে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ঘুষের শিকার হয়েছেন ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাংক থেকে ভাতা ও রেমিট্যান্স উত্তোলনে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৪ দশমিক ২ শতাংশ, ঘুষ দিয়েছেন ১ দশমিক ৭ শতাংশ। সমাজসেবা কার্যালয়ে শনাক্তকরণ ও সুবর্ণ কার্ড পেতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ঘুষ দিয়েছেন ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। কভিড-১৯-এর চিকিৎসায়ও হয়রানির শিকার হয়েছেন প্রতিবন্ধীরা।
অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় টিআইবির প্রতিবেদনে ১৪ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিবন্ধিতার উন্নয়ন সূচকে যে ধারণার কথা বলা হয়, বাস্তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। তারা উন্নয়নের অংশীদার হতে পারছেন না। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও তাদের অংশগ্রহণ অনুকম্পার ওপর নির্ভর করে। অথচ তারাও সবার মতোই সমান অধিকার পাবেন। এ অবস্থার উত্তরণে সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম নিরীক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে।
মন্তব্য করুন