- বাংলাদেশ
- পিপলস লিজিং হরিলুটে ব্যাংকার-ব্যবসায়ী
পিপলস লিজিং হরিলুটে ব্যাংকার-ব্যবসায়ী
আদালতে উজ্জ্বল কুমার নন্দীর জবানবন্দি

পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক ভিত ধ্বংস করে দেওয়ার পেছনে একাধিক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা ও দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। এই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদও প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করার পেছনে দায়ী। সব কিছুতে ছিল পলাতক পি কে হালদারের প্রত্যক্ষ হাত। পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুল ইসলামের আদালতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালত সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গত সোমবার তাকে আদালতে আনা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
জবানবন্দিতে বলা হয়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। দুর্নীতির পথ-ঘাট খোলা রাখা ও অবাধে দুর্নীতি করার জন্য পি কে হালদারই মূলত তাকে চেয়ারম্যান পদে বসান। এর জন্য পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেমকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে জড়িত হিসেবে শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক (অর্থ) আরেফিন শামসুল আলামিন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পি কে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, রিলায়েন্স লিজিং ও পিপলস লিজিংয়ের শীর্ষ পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে ইন্টারপোলের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে।
জবানবন্দিতে বলা হয়, পিপলস লিজিং থেকে দুই দফায় আড়াই কোটি করে মোট ৫ কোটি টাকা ঋণ নেয় আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট। পরে এই ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পিপলস লিজিংয়ে কোনো ফাইল নেই। অথচ সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের প্রসপেকটাসে এই বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
তিনি (উজ্জ্বল কুমার নন্দী) চেয়ারম্যান থাকাকালে ৬৬ কাঠা জমি বিক্রি-সংক্রান্ত অনিয়ম হয়েছে। জমিটি পি অ্যান্ড হাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি করা হয়। পিপলস লিজিংয়ে জমির টাকা পরিশোধ হয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল ও এফএএস লিজিং থেকে। এগুলো পরোক্ষভাবে পি কে হালদারের কোম্পানি। জমি বিক্রির ১২০ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিংয়ে স্থানান্তর হয়েছে। ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম এ জমিটি বিক্রি বাবদ ৬ কোটি টাকা ও চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার জন্য ১২ কোটিসহ মোট ১৮ কোটি টাকা পি কে হালদারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন।
অপরদিকে জেনিথ অ্যান্ড জেফার মূলত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান, যা ছিল সামসুল আলামিন গ্রুপের ও এর পক্ষে পাওয়ার অব অ্যার্টনি ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম। ঢাকার ৭৩, গ্রীন রোডের ৬৬ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য অগ্রীম হিসেবে সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ কোটি টাকা গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে মোয়াজ্জেম ও সামসুল আরেফিন আলামিন তাদের পিপলস লিজিংয়ের ঋণ সমন্বয় করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ১২ কোটি টাকা ও শামসুল আরেফিন আলামিন ২৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ ওই সময়ের পরিচালকরা। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা ও দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর, সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূলধন উপহার দেওয়া হয়েছিল মর্মে রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া হুসা ভাসি প্রতিবেদনে এ বিষয়টি স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য শুধু তিনিসহ বর্তমান পর্ষদ দায়ী নয়। আগের পর্ষদও দায়ী। পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকবৃন্দ অবৈধভাবে বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। গত ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটম্যান্টে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। ভুয়া, অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা গ্রহণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠন থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছিল। ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। কল লোন ও ওভার ড্রাফট ৭৪ কোটি টাকা কম দেখানো হয়েছিল।
আরও বলা হয়, পি কে হালদার ২০১৪ সালের দিকে চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরীর কাছ থেকে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার রেডিসন হোটেলটি ক্রয় করেন। এর চেয়ারম্যান হলেন পি কে হালদার, এমডি মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, অমিতাভ অধিকারী, রতন কুমার বিশ্বাস ও আনান কেমিক্যাল। পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ে এমডি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কৌশলে ভুয়া কোম্পানি সৃষ্টি করে সেখান থেকে অর্থ বের করে এ হোটেল ক্রয় করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন আবদুল আলিম। আলিমের সহায়তায় পি কে হালদার দুবাইসহ অন্যান্য দেশে অর্থ পাচার করেছেন। মূলত পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্ন কায়দায় ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা বের করেন। পরে চাপে পড়ে গেলে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেছিলেন। এ কাজে নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, সৈয়দ আবেদ হাসানসহ প্রায় ৪০-৪২ জনকে ব্যবহার করেছেন।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার আরও বলেন, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রকৃতপক্ষে তার ছিল না। পি কে হালদার তাকে চেয়ারে বসিয়েছেন। সবকিছু পরোক্ষভাবে তিনিই করতেন। গত ২০১৫ সালের নভেম্বরে পিপলস লিজিংয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাই। পি কে হালদারের কথামতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক মো. নওশেরুল ইসলাম ও বাসুদেব ব্যানার্জীদের প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং ও এমটিবি মেরিনকে ঋণ দিই। প্রকৃতপক্ষে দিয়া শিপিংয়ের কোনো কোম্পানি নেই। শুধু জমি আছে। এটা পরে জানতে পারি। ঋণের পুরো অর্থই এ দুটি প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসহ বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ। পরে জানতে পারি যে, ১৫৮টি ফাইল আমার সময়ে গায়েব হয়েছে। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী আরও বলেন, ২০১৩ সালে গোল্ডেন ইন্স্যুরেন্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই কনসালটেন্সি ফার্মের কাজ শুরু করি। নতুন কাস্টমারের খোঁজে পি কে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে তার বিভিন্ন কোম্পানির কনসালটেন্সির কাজ করার অফার দেন। পরে নর্দান জুট মিলস কেনার জন্য সরেজমিন পি কে হালদারের সঙ্গে নর্দান জুট মিল পরিদর্শনে যাই। মিল কেনার জন্য পি কে হালদার বেশ আগ্রহী হন এবং আমাকে স্বাধীন পরিচালক হতে বলেন। আমার কাছে কোনো টাকা না থাকায় পি কে হালদার তার সহযোগী রতন কুমার পালের সঙ্গে আমার ঋণ অ্যাগ্রিমেন্ট দেখিয়ে নর্দান জুট মিলের তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার আমার নামে ক্রয় করেন। আমি ছাড়াও অমিতাভ অধিকারী ওই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। পরে এই কোম্পানির নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় এবং আমাকে নর্দান জুট মিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা চলে যায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
পি কে হালদারের বান্ধবীদের বিষয়ে বলা হয়, তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। অবন্তিকা ও রুনাইয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে ২০-২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন পি কে হালদার। অবন্তিকা রুনাইয়ের মধ্যে ছিল পি কে হালদারকে নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার সঙ্গে আলাদা আলাদা সময় কাটাতেন। সবাই রুনাইকে বড় আপা ও অবন্তিকাকে ছোট আপা বলে ডাকত। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও অবন্তিকা চালাতেন পিপলস লিজিং। রুনাইর অসীম ক্ষমতার উৎস ছিল পি কে হালদার। তাই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কয়েক বছরে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭২ কোটির টাকার ট্রানজেকশন হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুল ইসলামের আদালতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালত সূত্রে এই খবর জানা গেছে।
দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে গত সোমবার তাকে আদালতে আনা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
জবানবন্দিতে বলা হয়, উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। দুর্নীতির পথ-ঘাট খোলা রাখা ও অবাধে দুর্নীতি করার জন্য পি কে হালদারই মূলত তাকে চেয়ারম্যান পদে বসান। এর জন্য পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেমকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
জবানবন্দিতে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে জড়িত হিসেবে শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক (অর্থ) আরেফিন শামসুল আলামিন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পি কে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, রিলায়েন্স লিজিং ও পিপলস লিজিংয়ের শীর্ষ পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে ইন্টারপোলের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে।
জবানবন্দিতে বলা হয়, পিপলস লিজিং থেকে দুই দফায় আড়াই কোটি করে মোট ৫ কোটি টাকা ঋণ নেয় আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেট। পরে এই ফাইলটি গায়েব করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পিপলস লিজিংয়ে কোনো ফাইল নেই। অথচ সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের প্রসপেকটাসে এই বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
তিনি (উজ্জ্বল কুমার নন্দী) চেয়ারম্যান থাকাকালে ৬৬ কাঠা জমি বিক্রি-সংক্রান্ত অনিয়ম হয়েছে। জমিটি পি অ্যান্ড হাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি করা হয়। পিপলস লিজিংয়ে জমির টাকা পরিশোধ হয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল ও এফএএস লিজিং থেকে। এগুলো পরোক্ষভাবে পি কে হালদারের কোম্পানি। জমি বিক্রির ১২০ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিংয়ে স্থানান্তর হয়েছে। ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম এ জমিটি বিক্রি বাবদ ৬ কোটি টাকা ও চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার জন্য ১২ কোটিসহ মোট ১৮ কোটি টাকা পি কে হালদারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন।
অপরদিকে জেনিথ অ্যান্ড জেফার মূলত একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান, যা ছিল সামসুল আলামিন গ্রুপের ও এর পক্ষে পাওয়ার অব অ্যার্টনি ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম। ঢাকার ৭৩, গ্রীন রোডের ৬৬ কাঠা জমি ক্রয়ের জন্য অগ্রীম হিসেবে সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ কোটি টাকা গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে মোয়াজ্জেম ও সামসুল আরেফিন আলামিন তাদের পিপলস লিজিংয়ের ঋণ সমন্বয় করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ১২ কোটি টাকা ও শামসুল আরেফিন আলামিন ২৫ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করেছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ ওই সময়ের পরিচালকরা। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা ও দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর, সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূলধন উপহার দেওয়া হয়েছিল মর্মে রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া হুসা ভাসি প্রতিবেদনে এ বিষয়টি স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য শুধু তিনিসহ বর্তমান পর্ষদ দায়ী নয়। আগের পর্ষদও দায়ী। পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকবৃন্দ অবৈধভাবে বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। গত ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটম্যান্টে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। ভুয়া, অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা গ্রহণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠন থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছিল। ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। কল লোন ও ওভার ড্রাফট ৭৪ কোটি টাকা কম দেখানো হয়েছিল।
আরও বলা হয়, পি কে হালদার ২০১৪ সালের দিকে চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরীর কাছ থেকে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার রেডিসন হোটেলটি ক্রয় করেন। এর চেয়ারম্যান হলেন পি কে হালদার, এমডি মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান, অমিতাভ অধিকারী, রতন কুমার বিশ্বাস ও আনান কেমিক্যাল। পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ে এমডি থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কৌশলে ভুয়া কোম্পানি সৃষ্টি করে সেখান থেকে অর্থ বের করে এ হোটেল ক্রয় করেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন আবদুল আলিম। আলিমের সহায়তায় পি কে হালদার দুবাইসহ অন্যান্য দেশে অর্থ পাচার করেছেন। মূলত পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্ন কায়দায় ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা বের করেন। পরে চাপে পড়ে গেলে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেছিলেন। এ কাজে নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, সৈয়দ আবেদ হাসানসহ প্রায় ৪০-৪২ জনকে ব্যবহার করেছেন।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার আরও বলেন, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা প্রকৃতপক্ষে তার ছিল না। পি কে হালদার তাকে চেয়ারে বসিয়েছেন। সবকিছু পরোক্ষভাবে তিনিই করতেন। গত ২০১৫ সালের নভেম্বরে পিপলস লিজিংয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাই। পি কে হালদারের কথামতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক মো. নওশেরুল ইসলাম ও বাসুদেব ব্যানার্জীদের প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং ও এমটিবি মেরিনকে ঋণ দিই। প্রকৃতপক্ষে দিয়া শিপিংয়ের কোনো কোম্পানি নেই। শুধু জমি আছে। এটা পরে জানতে পারি। ঋণের পুরো অর্থই এ দুটি প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসহ বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ। পরে জানতে পারি যে, ১৫৮টি ফাইল আমার সময়ে গায়েব হয়েছে। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী আরও বলেন, ২০১৩ সালে গোল্ডেন ইন্স্যুরেন্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই কনসালটেন্সি ফার্মের কাজ শুরু করি। নতুন কাস্টমারের খোঁজে পি কে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাকে তার বিভিন্ন কোম্পানির কনসালটেন্সির কাজ করার অফার দেন। পরে নর্দান জুট মিলস কেনার জন্য সরেজমিন পি কে হালদারের সঙ্গে নর্দান জুট মিল পরিদর্শনে যাই। মিল কেনার জন্য পি কে হালদার বেশ আগ্রহী হন এবং আমাকে স্বাধীন পরিচালক হতে বলেন। আমার কাছে কোনো টাকা না থাকায় পি কে হালদার তার সহযোগী রতন কুমার পালের সঙ্গে আমার ঋণ অ্যাগ্রিমেন্ট দেখিয়ে নর্দান জুট মিলের তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকার শেয়ার আমার নামে ক্রয় করেন। আমি ছাড়াও অমিতাভ অধিকারী ওই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। পরে এই কোম্পানির নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় এবং আমাকে নর্দান জুট মিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের টাকা চলে যায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।
পি কে হালদারের বান্ধবীদের বিষয়ে বলা হয়, তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। অবন্তিকা ও রুনাইয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে ২০-২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন পি কে হালদার। অবন্তিকা রুনাইয়ের মধ্যে ছিল পি কে হালদারকে নিয়ে চরম প্রতিযোগিতা। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার সঙ্গে আলাদা আলাদা সময় কাটাতেন। সবাই রুনাইকে বড় আপা ও অবন্তিকাকে ছোট আপা বলে ডাকত। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও অবন্তিকা চালাতেন পিপলস লিজিং। রুনাইর অসীম ক্ষমতার উৎস ছিল পি কে হালদার। তাই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কয়েক বছরে তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭২ কোটির টাকার ট্রানজেকশন হয়েছে।
মন্তব্য করুন