- বাংলাদেশ
- পাস বন্ধ থাকলেও সচিবালয়ে ভিড়
পাস বন্ধ থাকলেও সচিবালয়ে ভিড়
তদবিরকারীদের অবৈধ প্রবেশ, শঙ্কা নিরাপত্তা নিয়ে

দিনাজপুর জেলার একজন শিক্ষক সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) ড. আব্দুল আলীম খানের রুমে অপেক্ষা করছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ সঠিক নয় এমন অভিযোগে রংপুর আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস তাদের স্কুলের এমপিও আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। এই হয়রানির বিষয়টি তিনি মন্ত্রীকে জানাতে এসেছেন। এখন তো সচিবালয়ে ঢোকার পাস বন্ধ, ঢুকলেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সচিবালয়ের গেটে ম্যানেজ করে ঢুকেছি।'
এমপিও তথা মান্থলি পেমেন্ট অর্ডারে বেসরকারি স্কুলশিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ পাওয়া শিক্ষকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা অনুমোদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। তাই দুর্ভোগ সত্ত্বেও দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষকদের উচ্চস্তরে নালিশ বা তদবির নিয়ে আসতে দেখা যায়।
গত ১ ফেব্রুয়ারির এই অভিজ্ঞতার পর আরও তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেল- দর্শনার্থী, ভুক্তভোগী, দালাল ও তদবিরবাজদের সচিবালয়ে প্রবেশের কৌশল সম্পর্কে এরূপ 'ম্যানেজ' করার স্বরূপ। অবৈধভাবে বিভিন্ন লোকের প্রবেশের ফলে নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান সচিবালয় থেকে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন তদবিরকারী তার গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। পরে তাদের একজনের কাছে সচিবালয়ে প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা দিলে সচিবালয়ে সব কাজ হয়। গত সপ্তাহে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কৃষি মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন তার স্ত্রীর বদলির তদবির করতে। তিনি পুলিশের একজন এসআইকে ৫০০ টাকা দিয়ে তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ওষুধ আমদানি-সংক্রান্ত আবেদনের অবস্থা জানতে পারছিলেন না একজন ব্যবসায়ী। সচিবালয়ে প্রবেশের পাস না থাকায় তিনি পরিচিত একজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তার গাড়িতে চড়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী যুগ্ম সচিব থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের দিন বাদে অন্য কার্যদিবসে পাঁচটি করে পাস ইস্যু করতে পারেন। কিন্তু পাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র কর্মকর্তারা নানাভাবে তদবির করছেন। গত কয়েক দিন সচিবালয়ে ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একাধিক জুনিয়র কর্মকর্তা সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য গেটে স্লিপ পাঠান। জুনিয়র কর্মকর্তাদের এমন স্লিপ বিধিভঙ্গের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা।
করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় এক বছর হলো বাইরের লোকের ভিড় কমাতে সচিবালয়ে দর্শনার্থীদের পাস দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিভাগের বিশেষ অনুমোদনে অতি জরুরি প্রয়োজনে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায়, শত শত দালাল বা তদবিরকারী প্রতিনিয়ত সচিবালয়ে প্রবেশ করছেন। আবার পেনশন, পদায়ন প্রভৃতি বিষয়ে দীর্ঘদিন জরুরি সেবা না পেয়ে বা বঞ্চিত হয়ে প্রতিকারের আশায় অনেক নাগরিক সচিবালয়ে ঢুকতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. আবু নাসারউদ্দিন গত ১৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা) মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফার কাছে উপমন্ত্রীর পক্ষে তিনজন ব্যক্তির সচিবালয়ে পাসের অনুমতির অনুরোধ করেন। পরে জানা যায়, ওই তিন ব্যক্তি অন্য উপায়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছিলেন। অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিব দর্শনার্থী প্রবেশের অনুমতির জন্য সচিবালয় নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছেন। এতে বিব্রত হচ্ছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে দালালরাও প্রশ্রয় পাচ্ছে।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ও তা দমনে পুলিশ-র্যাবের বহু সফল অভিযানের পটভূমিতে সচিবালয়ে অবৈধ প্রবেশ বন্ধ করা, প্রবেশদ্বারের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও এ বিষয়ে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে সচিবালয়ে রোববার থেকে মঙ্গলবার প্রায় দুই হাজার এবং বুধ-বৃহস্পতিবার প্রায় দেড় হাজার দর্শনার্থী প্রবেশ করেন। তাদের অধিকাংশ দালাল ও তদবিরবাজ। করোনা মহামারির মধ্যেও অবৈধভাবে প্রবেশ চলছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে দর্শনার্থী পাস চালু করার জন্য তাগিদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর ফাইলও উপস্থাপন করা হয়।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সচিবালয়ে প্রবেশে পাস বন্ধ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দর্শনার্থী ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রবেশের পাস কবে চালু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এটা করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অবসরে যাওয়া এক অধ্যাপক বলেন, পেনশন-সংক্রান্ত ফাইলে সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক ছিল। এরপর দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তিনি পেনশনের টাকা পাননি। মন্ত্রণালয় থেকে তাকে কোনো সমস্যার কথাও জানানো হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে এক তদবিরকারীর সহযোগিতায় পেনশনের টাকা পেয়েছেন। অথচ সরকার পেনশন নীতিমালা এখন সহজ করেছে। একইভাবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগসহ বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জরুরি সেবা পেতে ভোগান্তিতে ভুগছেন সাধারণ নাগরিকরা। এছাড়া প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সচিবালয়ে প্রবেশের জরুরি প্রয়োজন হয়। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাকারিয়া পলাশ সচিবালয়ে সেবা নিতে এসে সমকালকে বলেন, সচিবালয়ে প্রবেশে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে তদবিরবাজ ও দালাল শ্রেণির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এজন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশের সুযোগ রাখা প্রয়োজন।
সচিবালয়ের ১৭ দশমিক ৫৭ একর জমিতে আটটি ভবন ও তিনটি টিনশেডে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং ১১টি (ছোট-বড়) হোটেল বা ক্যান্টিন রয়েছে। আছে একটি করে এটিএম বুথ, সাংবাদিক কক্ষ, ডে-কেয়ার সেন্টার ও ক্লিনিক। কোনো ভবনেই নেই নিজস্ব গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা সঙ্গিন। সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েকটি ভবনকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অল্প জায়গায় প্রচুর মানুষের সমাগমে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাবে। ফলে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার আগে সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশের নিয়ম একেবারে শিথিল করতে চায় না সরকার। এজন্য শুধু জরুরি সভা ও বিভিন্ন শুনানির জন্য পাস ইস্যু করা হচ্ছে। এসব পাসের জন্য একদিন আগে চিঠি দিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে জানাতে হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, পাস বন্ধ হওয়ার পর কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন কিছু ভিজিটর তার দপ্তরে আসছেন। অধস্তন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ে ভিজিটর কম আসায় কাজ করতে তাদের সুবিধা হচ্ছে। জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা) মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা সমকালকে বলেন, সচিবালয়ে প্রবেশ পাসের জন্য প্রচুর চাপ আসছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। ডিএমপির (সচিবালয়ের নিরাপত্তা শাখা) উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম সমকালকে বলেন, অনেক ব্যক্তির সচিবালয়ে জরুরি কাজ থাকে কিন্তু ঢুকতে পারেন না। এরপর তারা মন্ত্রী-সচিবদের কাছে অনুরোধ করেন। মন্ত্রী-সচিবের দপ্তর থেকে আমাদের জানানো হলে আমরা তাৎক্ষণিক কিছু ব্যক্তিকে ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দিচ্ছি। তবে কেউ যেন অসদুপায় অবলম্বন করে ঢুকতে না পারে, এজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয়ের গেটে দেখভাল করছেন।
করোনা মহামারির মধ্যে গত ৪ আগস্ট লকডাউন তুলে সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অফিস করার নির্দেশনা দেওয়ার পর ধীরে ধীরে সচিবালয়ে দর্শনার্থী বাড়ে। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ১২টি স্বাস্থ্যবিধির বেশিরভাগই মানা হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের শুরুতে সচিবালয় ক্লিনিকের উদ্যোগে প্রবেশপথে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা হলেও প্রায় আট মাস ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এখন প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও নেই।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, ভালো উদ্দেশ্যে সচিবালয়ের পাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সাধারণ নাগরিকদের সেবা যথাসময়ে নিশ্চিত করতে হবে। গেটে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের এখন কাজের চাপ কম। অবৈধভাবে প্রবেশ করে যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কাছে তদবির নিয়ে যাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
এমপিও তথা মান্থলি পেমেন্ট অর্ডারে বেসরকারি স্কুলশিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ পাওয়া শিক্ষকদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা অনুমোদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। তাই দুর্ভোগ সত্ত্বেও দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষকদের উচ্চস্তরে নালিশ বা তদবির নিয়ে আসতে দেখা যায়।
গত ১ ফেব্রুয়ারির এই অভিজ্ঞতার পর আরও তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেল- দর্শনার্থী, ভুক্তভোগী, দালাল ও তদবিরবাজদের সচিবালয়ে প্রবেশের কৌশল সম্পর্কে এরূপ 'ম্যানেজ' করার স্বরূপ। অবৈধভাবে বিভিন্ন লোকের প্রবেশের ফলে নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান সচিবালয় থেকে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন তদবিরকারী তার গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। পরে তাদের একজনের কাছে সচিবালয়ে প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা দিলে সচিবালয়ে সব কাজ হয়। গত সপ্তাহে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক কৃষি মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন তার স্ত্রীর বদলির তদবির করতে। তিনি পুলিশের একজন এসআইকে ৫০০ টাকা দিয়ে তার মোটরসাইকেলের পেছনে বসে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ওষুধ আমদানি-সংক্রান্ত আবেদনের অবস্থা জানতে পারছিলেন না একজন ব্যবসায়ী। সচিবালয়ে প্রবেশের পাস না থাকায় তিনি পরিচিত একজন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তার গাড়িতে চড়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী যুগ্ম সচিব থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের দিন বাদে অন্য কার্যদিবসে পাঁচটি করে পাস ইস্যু করতে পারেন। কিন্তু পাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র কর্মকর্তারা নানাভাবে তদবির করছেন। গত কয়েক দিন সচিবালয়ে ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একাধিক জুনিয়র কর্মকর্তা সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য গেটে স্লিপ পাঠান। জুনিয়র কর্মকর্তাদের এমন স্লিপ বিধিভঙ্গের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরা।
করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় এক বছর হলো বাইরের লোকের ভিড় কমাতে সচিবালয়ে দর্শনার্থীদের পাস দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিভাগের বিশেষ অনুমোদনে অতি জরুরি প্রয়োজনে কেউ প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায়, শত শত দালাল বা তদবিরকারী প্রতিনিয়ত সচিবালয়ে প্রবেশ করছেন। আবার পেনশন, পদায়ন প্রভৃতি বিষয়ে দীর্ঘদিন জরুরি সেবা না পেয়ে বা বঞ্চিত হয়ে প্রতিকারের আশায় অনেক নাগরিক সচিবালয়ে ঢুকতে না পেরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) মো. আবু নাসারউদ্দিন গত ১৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা) মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফার কাছে উপমন্ত্রীর পক্ষে তিনজন ব্যক্তির সচিবালয়ে পাসের অনুমতির অনুরোধ করেন। পরে জানা যায়, ওই তিন ব্যক্তি অন্য উপায়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছিলেন। অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিব দর্শনার্থী প্রবেশের অনুমতির জন্য সচিবালয় নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছেন। এতে বিব্রত হচ্ছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে দালালরাও প্রশ্রয় পাচ্ছে।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ও তা দমনে পুলিশ-র্যাবের বহু সফল অভিযানের পটভূমিতে সচিবালয়ে অবৈধ প্রবেশ বন্ধ করা, প্রবেশদ্বারের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও এ বিষয়ে পূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে সচিবালয়ে রোববার থেকে মঙ্গলবার প্রায় দুই হাজার এবং বুধ-বৃহস্পতিবার প্রায় দেড় হাজার দর্শনার্থী প্রবেশ করেন। তাদের অধিকাংশ দালাল ও তদবিরবাজ। করোনা মহামারির মধ্যেও অবৈধভাবে প্রবেশ চলছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে দর্শনার্থী পাস চালু করার জন্য তাগিদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর ফাইলও উপস্থাপন করা হয়।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সচিবালয়ে প্রবেশে পাস বন্ধ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দর্শনার্থী ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রবেশের পাস কবে চালু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এটা করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অবসরে যাওয়া এক অধ্যাপক বলেন, পেনশন-সংক্রান্ত ফাইলে সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক ছিল। এরপর দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তিনি পেনশনের টাকা পাননি। মন্ত্রণালয় থেকে তাকে কোনো সমস্যার কথাও জানানো হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে এক তদবিরকারীর সহযোগিতায় পেনশনের টাকা পেয়েছেন। অথচ সরকার পেনশন নীতিমালা এখন সহজ করেছে। একইভাবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত, স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগসহ বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জরুরি সেবা পেতে ভোগান্তিতে ভুগছেন সাধারণ নাগরিকরা। এছাড়া প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সচিবালয়ে প্রবেশের জরুরি প্রয়োজন হয়। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাকারিয়া পলাশ সচিবালয়ে সেবা নিতে এসে সমকালকে বলেন, সচিবালয়ে প্রবেশে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে তদবিরবাজ ও দালাল শ্রেণির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এজন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাধারণ নাগরিকদের প্রবেশের সুযোগ রাখা প্রয়োজন।
সচিবালয়ের ১৭ দশমিক ৫৭ একর জমিতে আটটি ভবন ও তিনটি টিনশেডে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং ১১টি (ছোট-বড়) হোটেল বা ক্যান্টিন রয়েছে। আছে একটি করে এটিএম বুথ, সাংবাদিক কক্ষ, ডে-কেয়ার সেন্টার ও ক্লিনিক। কোনো ভবনেই নেই নিজস্ব গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা সঙ্গিন। সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। কয়েকটি ভবনকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অল্প জায়গায় প্রচুর মানুষের সমাগমে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে যাবে। ফলে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার আগে সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশের নিয়ম একেবারে শিথিল করতে চায় না সরকার। এজন্য শুধু জরুরি সভা ও বিভিন্ন শুনানির জন্য পাস ইস্যু করা হচ্ছে। এসব পাসের জন্য একদিন আগে চিঠি দিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগে জানাতে হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সমকালকে বলেন, পাস বন্ধ হওয়ার পর কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন কিছু ভিজিটর তার দপ্তরে আসছেন। অধস্তন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ে ভিজিটর কম আসায় কাজ করতে তাদের সুবিধা হচ্ছে। জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সচিবালয় নিরাপত্তা) মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা সমকালকে বলেন, সচিবালয়ে প্রবেশ পাসের জন্য প্রচুর চাপ আসছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। ডিএমপির (সচিবালয়ের নিরাপত্তা শাখা) উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম সমকালকে বলেন, অনেক ব্যক্তির সচিবালয়ে জরুরি কাজ থাকে কিন্তু ঢুকতে পারেন না। এরপর তারা মন্ত্রী-সচিবদের কাছে অনুরোধ করেন। মন্ত্রী-সচিবের দপ্তর থেকে আমাদের জানানো হলে আমরা তাৎক্ষণিক কিছু ব্যক্তিকে ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দিচ্ছি। তবে কেউ যেন অসদুপায় অবলম্বন করে ঢুকতে না পারে, এজন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয়ের গেটে দেখভাল করছেন।
করোনা মহামারির মধ্যে গত ৪ আগস্ট লকডাউন তুলে সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অফিস করার নির্দেশনা দেওয়ার পর ধীরে ধীরে সচিবালয়ে দর্শনার্থী বাড়ে। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতারা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ১২টি স্বাস্থ্যবিধির বেশিরভাগই মানা হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের শুরুতে সচিবালয় ক্লিনিকের উদ্যোগে প্রবেশপথে থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা হলেও প্রায় আট মাস ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এখন প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও নেই।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, ভালো উদ্দেশ্যে সচিবালয়ের পাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং সাধারণ নাগরিকদের সেবা যথাসময়ে নিশ্চিত করতে হবে। গেটে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের এখন কাজের চাপ কম। অবৈধভাবে প্রবেশ করে যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কাছে তদবির নিয়ে যাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মন্তব্য করুন