- বাংলাদেশ
- মাথা নত না করার প্রত্যয়ের দিন
মাথা নত না করার প্রত্যয়ের দিন

বাংলায় 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' বলে একটা প্রবাদ আছে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গ এলে বাংলার জনপ্রিয় এই প্রবাদটির কথাই সবার আগে মনে পড়ে। ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা নড়েচড়ে বসি, টানটান হয়ে উঠি। শুধু নড়েচড়ে বসা আর টানটান হয়ে ওঠা নয়, তুমুল হৈচৈ লাগিয়ে দিই। জীবন ও সমাজের সর্বস্তরে কেন বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে না, তা নিয়ে একে অন্যের ওপর দোষারোপ করতে থাকি। দেশের সরকারও সচেতন হয়ে ওঠে এ সময়। নামফলক, গাড়ির নম্বর- সবকিছু বাংলায় লেখার জন্য তাগিদ আসতে থাকে। তার পর ফেব্রুয়ারি মাসটি চলে গেলেই সবকিছুতে ভাটা পড়ে। এ বছরও যে এমনটা হবে- সে কথাও নির্দি্বধায় বলা চলে।
কিন্তু কেন এমনটি হয়, তার সুলুক সন্ধান খুবই জরুরি। সে জন্য অনেক কিছু ধরেই টান দিতে হবে। বিবেচনায় আনতে হবে দূর অতীত ও নিকট অতীতের ইতিহাসের কথা, সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের কথা, দায়িত্বশীল ও নীতিনির্ধারণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত তাদের সবার কথা। আমাদের দেখতে হবে, দেশের দায়িত্বশীলরা কতটা সচেতন ও উদ্যোগী; তাদের নিত্যনৈমিত্তিক, দাপ্তরিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি কতটুকু আছে; তাদের সন্তানদের শিক্ষায় বাংলা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে; সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হোক- প্রকৃতপক্ষেই তারা চান কিনা। তারা যদি সত্যিই চান তাহলে কীভাবে একটা দেশে বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মধ্যম, মাদ্রাসা, ক্যাডেট কলেজ- চারটা শিক্ষা ব্যবস্থা থাকে? আমাদের দেশের দায়িত্ববান নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলা কতটা গুরুত্ব বহন করে, তাদের কাছে বাংলা কতটা সহজাত বা প্রয়োজনীয় তার ওপর নির্ভর করছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হবে কিনা।
একুশে ফেব্রুয়ারি জাতি হিসেবে মাথা নত না করার প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার দিন। যে ভাষাকে কেন্দ্র করে জন্ম নিয়েছে একটি জাতি, একটি রাষ্ট্র- বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ যেদিন উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন; তার মুখের ওপরেই আমরা সেদিন 'না, না' বলে উঠে গেলাম। সেদিন থেকেই মাতৃভাষার মর্যাদা সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা দেখা দিয়েছিল। আমাদের নিজস্ব জাতিসত্তা সম্পর্কেও বোধের জাগরণ ঘটে গিয়েছিল। বলতে গেলে সেদিনই পাকিস্তানের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসা তথা আমাদের নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ভাবনার ভ্রূণ উদ্গম হয়েছিল। সেই ভ্রূণটি আস্তে আস্তে পুষ্ট হতে হতে একদিন স্বাধীনতার বাস্তব রূপ ধরল। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বিধিবদ্ধ করেছিলাম- বাংলাই দেশের রাষ্ট্রভাষা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সব কাজ-কর্মসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে একমাত্র বাংলারই ব্যবহার চলবে। কেবল ভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোগ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে অন্য কোনো ভাষার ব্যবহার করা হবে না। বাংলা ভাষার এ রকম ব্যবহারকে নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনেও যে উদ্যোগী হতে হবে, সে সম্পর্কেও আমাদের বোধ অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। আবার সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাকেও যে চালু রাখতে হবে, সে ব্যাপারেও আমাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। আমরা জানতাম, ইংরেজি মাধ্যমে ভিন্ন জাতির সঙ্গে সংযোগ রক্ষাই শুধু হবে না; বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সম্পদ আহরণ করে আমাদের নিজস্ব ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার পথও খোলা থাকবে।
এসব কথাই আমরা জানি। কিন্তু মানি কিনা- সেটাই প্রশ্ন। মানি না যে- সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু কেন মানি না, সেটাই বুঝে নেওয়া দরকার। স্বাধীনতার আগের অবস্থা থেকে পরের অবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে আমরা সবাই ছিলাম ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাহীনতার সেই ঐক্যবদ্ধতাই আমাদের সবাইকে অভিন্ন রকমের ভাবনা ভাবিয়েছিল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রয়োগের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে তেমন কোনো ভিন্নমত ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পরে অবস্থাটি উল্টে গেল। আগে আমাদের শাসক ছিল ভিন্ন জাতির মানুষ। আর স্বাধীন দেশে আমাদের স্বদেশ ও স্বভাষীদেরই একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হলো আমাদের শাসক। নতুন শাসক হয়ে এই গোষ্ঠীটির বোল ও ভোল দুই-ই পাল্টে গেল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের থেকে তারা পরিণত হলো একটি আলাদা শোষক শ্রেণিতে। এই শোষক শ্রেণিটি হলো দেশের শাসক শ্রেণি। এই শ্রেণি-শাসন বিদেশেরই হোক আর স্বদেশেরই হোক, তার প্রকৃতিতে কোনো ভিন্নতা থাকে না। শ্রেণি-চরিত্র সর্বক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন। আমাদের স্বদেশি ও স্বভাষী শাসক শ্রেণিটি অন্য সবকিছুর মতো ভাষার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে লেগে গেল। বাঙালি হয়েও সন্তানদের বাংলা ভুলিয়ে দেওয়াকে গৌরবজনক মনে করল। এখানে ওখানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল। সংবিধান বা দেশের আইনে যে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, সে বিধানকে তারা অনায়াসে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে লাগল। রাজা হয়ে বসেছে বলে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। কারণ রাজার ইচ্ছাতেই রাজ্য চলে। প্রজারাও রাজার অনুকরণ করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও প্রজাদেরও অনেকে নিজেদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়িয়ে জাতে উঠতে চায়। এভাবেই সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের কথাটি কেবল কথার কথাই হয়ে থাকে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলে সবার মধ্যে পুরোনো বোধ জেগে ওঠে বলে বাংলা ভাষা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চলতে থাকে এবং বাংলা ব্যবহারের নির্দেশও জারি হতে থাকে। আবার কিছুদিন পরই সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বাংলা ভাষা মর্যাদাহীন অবস্থাতেই পড়ে থাকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধও ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদেরও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে কোনো অসুবিধা হয় না।
এ রকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতেই হবে। কিন্তু কেবল ঘোষণা দিয়েই সে পরিবর্তন আসবে না। প্রকৃত পরিবর্তন সাধনের জন্য সমগ্র ব্যবস্থাটির খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। সেই পাল্টে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর কথা এখানে-ওখানে অনেক সময়ই শোনা যায়। তবে এর প্রকৃত তাৎপর্যটি যে আমরা সবাই অনুভব করি; তেমন মনে হয় না। যদি অনুভব করতাম, তাহলে এও বুঝে নিতাম যে শোষক শ্রেণি কে? সে শ্রেণি স্বদেশি বা বিদেশি যাই হোক, ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া যথার্থ অর্থে মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণতা ঘটতে পারে না। আমরা তো ভুলেই গিয়েছি- শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলেই স্বাধীন দেশে এক নতুন শোষক শ্রেণির অধীন হতে বাধ্য হলাম আমরা। সেই শ্রেণিটি যতদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে ততদিন আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না; প্রকৃত স্বাধীনও আমরা হবো না। তাই বলছি, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অর্থহীন হইচই না করে, কিংবা নানা রকম ঘোষণা দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার চিন্তা না করে, প্রথমেই নজর দিতে হবে সংখ্যালঘু শোষক শ্রেণির উচ্ছেদ ঘটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সেই রাজত্বে শোষকও যেমন থাকবে না, শোষিতও থাকবে না। সে রাজত্বটি এমন হবে, যেখানে 'আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে'।
আমার এমন বক্তব্য অনেকের কাছেই ইউটোপিয়া বলে মনে হতে পারে। আসলে তা নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কোনোমতেই ইউটোপিয়া ছিল না। সেই লক্ষ্যকে বাস্তব করে তুলতে পারলেই আমাদের মাতৃভূমিটি যথার্থ অর্থে আমাদের হবে; মাতৃভাষারও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তা না হলে বছর বছর ফেব্রুয়ারি আসবে এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে।
মন্তব্য করুন