- বাংলাদেশ
- বড়দের দ্বন্দ্বে মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে না সাঁওতাল শিশুরা
বড়দের দ্বন্দ্বে মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে না সাঁওতাল শিশুরা

সাঁওতালি ভাষার লিপি নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। বাংলাদেশ, ভারতসহ চার দেশে বিভক্ত সাঁওতালরা বেশ কয়েক ধরনের হরফ দিয়ে ভাষাটি লিখে থাকেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী শুদ্ধ এবং জাতিসংঘের ইউনিকোড রেজিস্ট্রেশনসহ ভারতের অনেক অঞ্চলেই সাঁওতালি লিখতে অলচিকি হরফকে গ্রহণ করলেও বাংলাদেশি সাঁওতালরা এ ব্যাপারে সর্বজনমান্য কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। এতে অন্য আদিবাসী ভাষাগুলোর বেশ কয়েকটির পাঠ্যবই প্রকাশিত হয়ে গেলেও দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘু জাতির সাঁওতালদের ভাষার বই প্রকাশ আটকে আছে হরফ নিয়ে দু'পক্ষের বিপরীত অবস্থানের কারণে। বড়দের এ দ্বন্দ্বে আটকে গেছে সাঁওতাল শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ।
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তা করে ২০১০ সালের প্রণীত শিক্ষানীতিতে প্রথম সরকারিভাবে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হয়। ২০১৩ সালের শুরুতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে জনসংখ্যার দিক থেকে বেশি প্রচলিত ছয়টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় চাকমা, মারমা, ককবরক, মান্দি ও সাদরি ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি হলেও আটকে যায় সাঁওতালি ভাষার বই। মন্ত্রণালয় গঠিত আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি ভাষার লিপি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাঁওতালি জনগোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয়দের দায়িত্ব দিলেও তারা কোনো সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। ২০১৭ সালে রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষায় পাঠ্যবই মুদ্রণ ও পাঠদানের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে সংশ্নিষ্ট জেলাগুলোর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা) সভাপতি করে কমিটি গঠনের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। এত কিছু করেও সাঁওতালি ভাষার লিখিত লিপি নিয়ে কোনো সুরাহা করা যায়নি।
ভাষার ইতিবৃত্ত : বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর লোকের বাস প্রায় এক কোটির ওপরে। সাঁওতালি ভাষা অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্ভুক্ত। মনে করা হয়, ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন কোল ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বর্তমানের সাঁওতালি ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে, 'দ্রাবিড়, আর্য আর তিব্বতি চিনা বা মঙ্গল জাতির লোক ভারতে আসবার কালেও কোল ভাষায় (অর্থাৎ কিনা আধুনিক কোল ভাষার অতি প্রাচীন রূপের) প্রচার এই দেশে ছিল।' এই কোল ভাষা থেকেই পরবর্তীকালে সাঁওতাল, মুন্ডারি, হো, করকু, শবরসহ বিভিন্ন ভাষার বিকাশ হয়েছে। এমনকি বাংলা ভাষায় ব্যবহূত বহু দেশি শব্দ সাঁওতালি ভাষা থেকে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে সাঁওতালি ভাষাটি মুখে মুখে প্রচলিত থাকলেও দীর্ঘদিন এই ভাষার কোনো বর্ণমালা ছিল না। খ্রিষ্টান মিশনারিরা প্রথমবার রোমান হরফকে কিছুটা পরিবর্তন করে সাঁওতালি ভাষার লিখিত রূপ তৈরি করেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের ময়ূরভঞ্জ জেলার সাঁওতাল কবি রঘুনাথ মুর্মু ১৯২৫ সালে সাঁওতালি ভাষা লেখার সুবিধার্থে অলচিকি লিপি তৈরি করেন, ১৯৩৯ সালে এই লিপি প্রচারিত হয়। এটিই সাঁওতালি ভাষার নিজস্ব লিপি হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সাল থেকে ভারতের মাধ্যমিকে পড়া সাঁওতাল শিক্ষার্থীরা এই লিপিতেই সব বিষয়ের পরীক্ষা দিয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যাসাগর, বর্ধমান, পুরুলিয়ার সিধু কানহু বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অলচিকি লিপিতে সাঁওতালি ভাষা পড়ানো হয়ে থাকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ভাষায় উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলা, ওড়িয়া ও দেবনাগরী হরফেও লেখালেখি করেন এই ভাষাভাষীরা। তবে বাংলাদেশে রোমান হরফের পাশাপাশি বাংলা ও অলচিকি হরফে সাঁওতালি ভাষা লেখা হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৯৯৯ সালে একটি এনজিওর সহায়তায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষার বই দিয়ে সাঁওতাল ভাষাশিক্ষার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল। ২০১৮ সালে আগস্টে দু'দেশের সাঁওতালদের যৌথ প্রচেষ্টায় উইকিপিডিয়া ফাউন্ডেশন 'সাঁওতালি উইকিপিডিয়া' চালু করে এবং সেখানে মূলত অলচিকি লিপিতে বিভিন্ন নিবন্ধ থাকলেও রোমান হরফেও নিবন্ধের সংখ্যা কম নয়।
বিতর্ক লিপি নিয়ে :সাঁওতালি উইকিপিডিয়া তৈরির সঙ্গে জড়িতদের অন্যতম মানিক সরেন সমকালকে বলেন, ২০১৯ সালে সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে শেষ কথা হয়েছিল। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। রোমান হরফ ছিল সাঁওতাল ভাষাভাষীদের ওপর প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে, শাসকরা চেয়েছে তাদের নিজেদের সংস্কৃতি ও ধর্ম স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিতে। এরই ধারায় সাঁওতালদের ধর্মান্তরিত করা ও ভাষাচর্চায় কৌশলে রোমান হরফ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাঁওতালি ভাষার জন্য অলচিকি লিপিকে ভাষাবিদরা সমর্থন করছেন।
মানিক সরেনের যুক্তিকে সমর্থন করেছেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। তিনি জানান, যারা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছেন, তাদের ধর্মগ্রন্থ রোমান হরফে লেখা হওয়ায় সাঁওতালি ভাষাকেও তারা রোমান হরফেই চান। সাঁওতালদের মূল স্রোত থেকে অনেক আগেই আলাদা হয়ে গিয়ে তারা সাঁওতালদের কোনো উৎসব বা পার্বণে অংশ নেন না, শুধু মুখের ভাষাটাই আছে।
সাঁওতালি ভাষা ও লিপিবিতর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেছেন গবেষক পাভেল পার্থ। তিনি বলেন, একটি ভাষার বর্ণমালা মানুষ যখন সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করে, সাহিত্যচর্চা হয়, তখন জাতিসংঘ সেটাকে ইউনিকোড (প্রতিটি ভাষার স্বতন্ত্র লিপির আলাদা কোড) স্বীকৃতি দেয়। অলচিকি লিপি এই স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই লিপি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ফন্ট হিসেবে এখন আলাদাভাবে কম্পিউটারে অলচিকি বর্ণমালা টাইপ করা যায়। লিপিবিতর্ক বিষয়ে তার মন্তব্য, ভাষাবিজ্ঞানে জোর-জবরদস্তি চলে না। পরিবর্তিত রোমান দিয়ে সাঁওতালি ভাষা লেখার যে চেষ্টা, সেটা বম ও লুসাই ভাষায়ও হয়েছে। রোমান দিয়ে সাঁওতালি ভাষা ভালোভাবে লেখা সম্ভব নয়। বাংলা দিয়েও সেটা পুরোপুরি হয় না। একমাত্র অলচিকি দিয়েই ভাষাটা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। জিনিসটিকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয়ভাবে বিতর্ক না টেনে বৈজ্ঞানিকভাবে ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাঁওতালি মতামতের দিক থেকে দেখলে অলচিকি হরফেই বই প্রকাশ করা উচিত। অলচিকিতে সম্ভব না হলে বাংলা হরফ দিয়ে বই প্রকাশ করা যেতে পারে, তবে রোমান হরফে বই প্রকাশ কোনো দিক থেকেই উচিত হবে না।
রোমান লিপির সমর্থক ও লেখক সুবোধ এম বাসকি সমকালকে বলেন, গণতন্ত্র দিয়ে সবকিছু হবে না। ভাষার ক্ষেত্রে লিপি কোনো সমস্যা নয়, অনেক ভাষা লিপি ছাড়াই টিকে আছে। সাঁওতালি ভাষাও বর্ণমালা ছাড়া টিকে আছে। মিশনারি আমলে রোমান হরফ দিয়ে ভাষাটি লেখা হয়। আগে মিশনারি স্কুলগুলোতেই রোমান হরফে সাঁওতালি ভাষা পড়ানো হতো। রোমান হরফে লেখার পেছনে ধর্মগ্রন্থের কোনো ভূমিকা নেই দাবি করে তিনি বলেন, অলচিকি লিপি নিয়ে রাজনীতি চলছে এবং রোমান হরফে লেখাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হচ্ছে। খ্রিষ্টান ধর্ম আসার অনেক আগেও রোমান হরফ ছিল। যারা এখন অলচিকির পক্ষে কথা বলছেন, তারা আগে রোমান হরফেই লিখতেন। প্রথমে তারা বাংলা হরফ চাচ্ছিলেন আর এখন চাচ্ছেন অলচিকি। তিনি আরও বলেন, ঝাড়খন্ডের সাঁওতাল পরগনার সালকান মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয় ও আসাম শিক্ষা বোর্ডে রোমান হরফে সাঁওতালি লেখা হয়। তবে সেখানে রোমানের পাশাপাশি দেবনাগরী লিপিও চলছে। ভাষাটা উত্তর ও দক্ষিণ দুই অংশে বিভক্ত। উত্তর পাশের বাংলাদেশ ও ঝাড়খন্ডে সাঁওতাল ভাষা শুরু থেকেই অবিকৃত আছে। দক্ষিণে অলচিকি ঢুকেছে বলে সেখানেই ভাষাটা বিকৃত হয়ে গেছে। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে সাঁওতাল ভাষার গবেষণা অপূর্ণ।
মন্তব্য করুন