স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সশরীরে অংশ নেওয়ার এবং ৬৫টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর বিষয়টি বাংলাদেশের অসাধারণ ঐতিহাসিক অর্জন- এ রকমই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট যে, সারাবিশ্ব বাংলাদেশের সাফল্যের কথা জেনেছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ছড়িয়ে পড়েছে এবং সার্বিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। সমকালের সঙ্গে আলাপে তারা আরও বলেন, এর ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে; বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর জাতীয় আয়োজন শুরু হয় ন্যাশনাল প্যারেড গ্রাউন্ডে। প্রথম দিন এতে অংশ নেন ও বক্তব্য দেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। এরপর ধারাবাহিকভাবে এ আয়োজনে অংশ নেন ও বক্তব্য দেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। সর্বশেষে গত ২৬ মার্চ ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছিল ভারত। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নেন ভারতীয় সেনারাও। ফলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সশরীরে উপস্থিতি ছিল দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কে গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধার প্রতিফলন।
এ ছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্র এবং সরকারপ্রধান ও জাতিসংঘের মহাসচিবসহ ৬৫টি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা। শুভেচ্ছাবার্তায় অনেকেই জানান, তারা বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক উদযাপনে সশরীরেই অংশ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির কারণে আসতে পারছেন না। অর্থাৎ, মহামারি পরিস্থিতি না থাকলে আরও অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি দেখা যেত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের 'মুজিব চিরন্তন' উদযাপন মঞ্চে।
বাংলাদেশের উদযাপনে অংশ নিতে এলেও দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের প্রত্যেকেই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন; প্রত্যেক দেশের সঙ্গেই সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তি সই হয়েছে। প্রতিটি দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রত্যেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাদের বক্তব্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশকে তারা উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে দৃষ্টান্ত হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
গত ১০ দিনের আয়োজন এবং পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সফরের গুরুত্ব তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য আরও একটি ঐতিহাসিক অর্জন। পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা আসার পর যদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নাও করতেন এবং কেবল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপন মঞ্চে বক্তব্য দিয়ে চলে যেতেন, তা হলেও বাংলাদেশের জন্য সেটিকে অসাধারণ অর্জনই বলতে হতো। কারণ কভিড-১৯ মহামারির মধ্যে তাদের সশরীর উপস্থিতিই জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশকে তারা কত গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে তিনি প্রথম সফর করলেন ঢাকায়। তিনি শুধু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদযাপনেই অংশ নেননি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেছেন। ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চলমান এবং অমীমাংসিত ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাণিজ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ বাড়ানো নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ত্রিদেশীয় যোগাযোগ স্থাপনের বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। পাঁচটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার অত্যন্ত গভীর সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্বের সামনে এসেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যত গভীর হবে, বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে দরকষাকষিতে এ দেশ তত এগিয়ে থাকবে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ট্রেজারার এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের এক সপ্তাহের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে আসা, বাংলাদেশের উদযাপনে অংশ নেওয়া এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সফর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের প্রতিফলন। প্রত্যেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও নিঃসন্দেহে আরও নিবিড় হয়েছে। যেমন ভুটানের সঙ্গে আলোচনায় সে দেশের উদ্বৃত্ত জলবিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি ও যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। নেপালের সঙ্গে জলাধার নির্মাণ এবং তাদের উদ্বৃত্ত জলবিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে আরও আগে থেকেই নানাভাবে আলাপ হচ্ছিল। এবার নেপালের রাষ্ট্রপতি ঢাকায় এসে এ ব্যাপারে সহযোগিতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক ও আকাশপথে যোগাযোগ বাড়ানোর কথা বলেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি উপ-আঞ্চলিক কিংবা ত্রিদেশীয় সহযোগিতার সম্পর্কের বিষয়ও নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে। এগুলো খুবই ইতিবাচক দিক।
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরদার হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভারতের ভূমিকাও আরও সক্রিয় হবে, আশা করা যায়। এই গৌরবময় উদযাপন বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও দারুণ উজ্জ্বল করেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সি ফায়েজ আহমেদ বলেন, প্রতিবেশী পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আসার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা আমাদের সৌহার্দ্যকে আরও দৃঢ় করেছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নানা রকমের টানাপোড়েন থাকতে পারে, নানা সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু তার পরও আমরা যে পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু তার প্রমাণ সবাই মিলে দিয়েছেন। সেদিক থেকে তাদের সফর এই পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে। সেই সঙ্গে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলো চলমান সহযোগিতার সম্পর্ককে আরও সম্প্রসারিত করবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, যদি কোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সফর নিয়ে দেশের কারও আপত্তি বা ভিন্নমত থাকে, তবে তারা তা প্রকাশ করতে পারেন। আইনের মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় নিজেদের মত ও যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু এজন্য সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড, যা আমাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তা কখনোই কাম্য নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়। এর ফলে আমাদের কোনো লাভ হবে না। বরং যে মতই থাকুক না কেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক যত বেশি বাড়বে, ততই সুফল পাওয়া যাবে। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে।

বিষয় : স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ

মন্তব্য করুন