- বাংলাদেশ
- পাঠকের দেখা নেই বইমেলায়
পাঠকের দেখা নেই বইমেলায়

'ধু-ধু করে যেদিক পানে চাই/কোনোখানে জনমানব নাই'- ছোটবেলায় প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বীরপুরুষ' কবিতার এসব লাইন সবারই পড়া। গতকাল সোমবার লকডাউনের প্রথম দিনে বইমেলা প্রাঙ্গণ ছিল যেন ঠিক কবিতার সেই লাইনগুলোর মতো- জনশূন্য, নীরব।
মেলার টিএসসির গেটের দিকে একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী। তাদের একজন দর্শনার্থী বেশ মজা করে বললেন, 'এখন মেলায় আসা দর্শনার্থীর চেয়ে বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীর সংখ্যাই বেশি হবে।' পাশের সঙ্গীরা হেসে কুটিকুটি হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দিলেন তাতে।
কথাটা কিন্তু একেবারে ভুল ছিল না। দুপুর ১২টার দিকে শুরু হলেও স্টল-প্যাভিলিয়নগুলোর বিক্রয়কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া তেমন কেউই ছিল না মেলায়। বই কিনতে ও ঘুরতে আসা কাউকে পেলেই বক্তব্য নিতে তাকে ছেঁকে ধরছিল টিভি মিডিয়াগুলো। তবে বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাগম কিছুটা বাড়লেও ১৫ লাখ বর্গফুটের মেলায় সেটি তেমন চোখেই পড়েনি।
এর আগে গত রোববার রাতের কালবৈশাখী খানিকটা আঁচড় কেটে গেছে মেলার গায়ে। অন্যপ্রকাশ, আদর্শ, সাহিত্যবিলাস, ন্যাশনাল পাবলিকেশন্সসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর কিছু বই ভিজেছে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে ছুটে আসা বৃষ্টিতে। আদর্শ প্রকাশনীর একজন বিক্রয়কর্মী জানান, 'গতকালের (রোববার) ঝড়ে আমাদের স্টলের কোনো ক্ষতি না হলেও ৫০-৬০টির মতো বই ভিজে গেছে।' সোমবার প্রায় সারাদিন স্টলের সামনে ত্রিপল ফেলে ভেজা বই শুকিয়েছে প্রকাশনীগুলো। টিএসসির গেটের দিকের স্টলগুলোর তেমন একটা ক্ষতি না হলেও রমনার দিকের গেটের স্টলগুলো বেশ ভালো করেই টের পেয়েছে ঝড়ের দাপট।
কয়েকটি স্টলের ব্যানার নাই হয়ে গেছে বাতাসের তোড়ে। তবে প্যাভিলিয়নগুলোর কাঠামো শক্ত থাকায় তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
তবে মূল ক্ষতিটা হয়েছে বিক্রিতে। লকডাউনের প্রথম দিনে বিক্রি খুব কম হয়েছে। প্যাভিলিয়নের প্রকাশনীগুলো অল্প বিক্রি করতে পারলেও স্টলগুলোর অবস্থা তথৈবচ। বিকেলের দিকে আদিত্য অনীকের ম্যানেজার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, 'মেলার শুরু থেকেই স্টল খুলে বসে আছি। এখনও কোনো ক্রেতা আসেনি। আমাদের এখানে প্রথমে চারজন বিক্রয়কর্মী থাকলেও খরচ কুলাতে না পেরে একজনকে বাদ দিয়েছি। প্রতিদিন স্টলের সাধারণ খরচই আছে ৩০০ টাকা। সে টাকার বইও তো বিক্রি করতে পারছি না।'
সাহিত্যপ্রকাশে গতকাল বিক্রি হয়েছে হাজার দুয়েক টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কামাল হোসেনের মতে, লকডাউন দিয়ে বইমেলা খোলা রাখলে মানুষজন আসবে না। তাদের এতে উল্টো ক্ষতি হচ্ছে।
প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি অংশও খুব একটা আগ্রহী নয় মেলায় স্টল চালাতে। বাবুই, চন্দ্রদ্বীপ বা মাতৃভাষার মতো অনেক প্রকাশনী তো স্টলই খোলেনি। দাঁড়িকমা প্রকাশনীর কর্ণধার আবদুল হাকিম নাহিদ বললেন, 'স্টল খোলা রেখে তো কোনো লাভ হচ্ছে না। যারা প্রকাশনাতে টাকা ঢেলেছেন, মেলার ১৯ দিন চলে গেলেও তাদের অনেকেই বিনিয়োগের দশ ভাগ টাকাও তুলে আনতে পারেননি।'
এসবের মধ্যেও মেলায় নতুন বই এসেছে। গতকাল সোমবার কথাপ্রকাশ এনেছে কবি ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব আজীজের উপন্যাস 'অপ্রকাশ্য'। এই উপন্যাসে তুলে আনা হয়েছে ২০১৯ সালের মার্চ থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালকে, যে সময়ে গণমানুষের বুকে চেপে বসেছিল করোনার ভয়াল আতঙ্ক। অদেখা, অজানা, বিষ্ফ্ময়কর নিয়তির আচমকা দমকে বিহ্বল চারদিক। এ উপন্যাসের মূলকথা তাই এই সময়কাল, যার অনেক কিছুই গোপন ও লুকানো। কথাপ্রকাশের এক বিক্রয়কর্মী জানান, বইটি প্রথম দিনেই পাঠকদের মনোযোগ টেনেছে।
এছাড়াও গত বৃহস্পতিবার মেলার ১৯তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৮টি। এর মধ্যে কবিতা ১০টি, প্রবন্ধ পাঁচটি, ইতিহাস তিনটি ও জীবনী দুটি। এছাড়া উপন্যাস, ছড়া, শিশুসাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, নাটক, ভ্রমণ, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ও অন্যান্য বই এসেছে একটি করে। নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'অপারেশন নীলাঞ্জনা' (অনুপম), তানভীর মোকাম্মেলের 'বিষাদনদী' (বেহুলাবাংলা), মাসরুর আরেফিনের 'আন্ডারগ্রাউন্ড' (কথাপ্রকাশ), আবু সাঈদ খানের 'বলা না বলা :সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি' (শ্রাবণ), ড. মশিউর মালেক সম্পাদিত শেখ মুজিবুর রহমানের 'বিশ্বশান্তি :আমার জীবন দর্শনের মূলনীতি' (ইতিহাস), জয়দীপ দে'র 'বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়' (কবি), হাসনাইন হীরার 'বাঁক বাচনের বৈঠা' (কাগজ প্রকাশ), নওশাদ জামিলের 'প্রত্যাবর্তন' (নালন্দা), খালেক বিন জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'ছড়া সমগ্র' (আকাশ), আমিনুর রহমান সুলতানের 'নির্বাচিত ঘেটুগান' (আল গাজী), হায়াৎ মামুদের অনুবাদে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের 'কিশোর উপযোগী নাট্যসমগ্র' (চারুলিপি), ভাস্কর চৌধুরীর 'তুমি আমার অবেলা' (যুক্ত), আহমদ মতিউর রহমানের 'নারিকেলবাড়িয়া থেকে বাংলাদেশ' (রয়েল পাবলিশার্স) ইত্যাদি।
মন্তব্য করুন