দরিদ্র থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। রয়েছে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণের পথে। বিশিষ্টজনের মতে, বাংলাদেশের উত্তরণের এ ধারায় নারীর অবদান অপরিসীম। খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ তার 'ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কাণ্ডজ্ঞান' বইয়ে ভারতের তুলনায় বিভিন্ন সূচকে এ দেশের এগিয়ে যাওয়ার বিবরণ তুলে ধরেছেন। অগ্রগতিমূলক এসব সূচকের বেশির ভাগই অর্জিত হয়েছে নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাবেক শিক্ষক জঁ দ্রেজ বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশে বেশি।'
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ সব রাজনৈতিক আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। ছিল নেতৃত্ব। নানা বাধা ভেঙে এগোচ্ছেন এবং পেশায় সফল হচ্ছেন নারী। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার পদে এবং মন্ত্রিসভাসহ উচ্চ পদগুলোতেও ঘটেছে নারীদের অন্তর্ভুক্তি। নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চ পদেও। দুই কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। ৩৫ লাখের বেশি নারী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করছেন, যেটি বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্র। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় সরকারে নারীরা সরাসরি অংশ নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও এগিয়েছেন।
মাধ্যমিক পর্যন্ত শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা চালু করায় করোনাকালেও বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তির হার উন্নীত হয়েছে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশে, যেখানে ১৯৯০ সালে এই হার ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। অবশ্য এ দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার বেলায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ব্যর্থতা রয়েছে প্রাথমিক স্তরের পর মেয়েশিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধেও।
নারীর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। এ খাতের সবচেয়ে উজ্জ্বল অর্জন তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যা বাড়ানো। দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যেও অন্যতম বাংলাদেশ। গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরিবৈষম্যও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের "ভয়েসেস টু চয়েসেস :বাংলাদেশ'স জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট" শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে। তবে চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনও কম। যদিও ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীর অংশ নেওয়ার হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ।
ব্যাংকে নারীর অংশগ্রহণ :সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই দিন দিন পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখন যারা চাকরিতে আসছেন, তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশিই নারী ব্যাংকার- আগে যা ছিল ১০ শতাংশেরও কম। অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি নারীকর্মীদের চাকরি বদলের কিংবা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাও আগের চেয়ে কমেছে।
বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক বাদে দেশে কার্যরত অন্য ৫৯টি তফসিলি ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোতে জনবলের সংখ্যা এক লাখ ৮৩ হাজার ২০৩। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এদের মধ্যে নারীকর্মীর সংখ্যা ২৮ হাজার ৩৭৮ জন। সে হিসাবে ব্যাংকগুলোতে নারীকর্মী ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। অন্যদিকে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৬ শতাংশ। দেশের ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ১৫ জন নারী চাকরি করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রারম্ভিক পর্যায়ে বেশি। ২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকে কর্মরত মোট নারীকর্মীর মধ্যে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ চাকরি বদল করেছেন। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট পরিচালকদের ১২ দশমিক ২০ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী পরিচালক রয়েছেন বিদেশি মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের পরিচালকদের ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ নারী। বেসরকারি ব্যাংকের ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ পরিচালক নারী। আর রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে এ হার ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
কৃষিতে নারীর অবদান :এটি ইতিহাস-স্বীকৃত, কৃষিসভ্যতার সূচনা নারীর হাতে। এ খাতে তারা এখনও বড় রকমের অবদান রাখেন। বিশ্বের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ৮০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদিত হয় পারিবারিক কৃষি থেকে। বাংলাদেশ মূলত ক্ষুদ্র কৃষির দেশ। এখনও ৫০ শতাংশ কৃষি খামার গ্রামীণ নারীর শ্রমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ শ্রম জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কৃষিতে নারীর সংশ্নিষ্টতা ৬৮ দশমিক ৮৪ থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী মনজুন নাহার বলেন, নারীর উন্নয়নে গ্রামীণ নারী কৃষকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। গ্রামীণ নারীরা শুধু ফসল কাটার মধ্যেই সীমিত নন; বিভিন্ন চাষাবাদেও তারা যুক্ত হয়েছেন। তারা জুম, মৎস্য, জৈব কৃষিসহ নানা ধরনের কৃষির চর্চায় সহযোগিতা করছেন। নারীদের এসব উদ্যোগ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষির ২৩টি কাজের মধ্যে ১৭টি নারীরা করে থাকেন। সেখানে কৃষির প্রায় সব ধরনের কাজ রয়েছে। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও নারীরা করে থাকেন। তবে যে নারীরা এত কিছু করছেন, তারাই কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।
বিচার আসনে নারী :১৯৭৪ সালে সরকার বিচারক (মুন্সেফ) পদে নিয়োগের জন্য প্রথম দরখাস্ত আহ্বান করে কাগজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেই নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের প্রথম নারী বিচারক হন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তার পথ ধরে দেশের বিচারাঙ্গনে ন্যায়দণ্ড হাতে আলো ছড়াচ্ছেন অসংখ্য নারী বিচারক। বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ৯৮ জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ছয়জন বিচারক রয়েছেন। সেখানে কোনো নারী বিচারপতি না থাকলেও উচ্চ আদালতের ৯২ জন বিচারপতির মধ্যে নারী বিচারপতি সাতজন।
এই সাত নারী বিচারপতির মধ্যে রয়েছেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি কাশেফা হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক। বিচারপতি সালমা মাসুদ ছাড়া ছয়জন বিচারপতিই হাইকোর্টের দ্বৈত ও একক বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। রিট, ফৌজদারি মোশন ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করছেন দ্রুততার সঙ্গে। দিচ্ছেন বিভিন্ন মামলায় যুগান্তকারী রায়। আর অধস্তন আদালতে কর্মরত রয়েছেন এক হাজার ৮৪৫ জন বিচারক। এর মধ্যে নারী বিচারক রয়েছেন ৫৪৪ জন, যারা জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ হিসেবে বিচারের আসনে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি চারজন নারী বিচারক গেছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। তারা সেখানে 'রুল অব ল' অ্যাডভাইজরি শাখায় প্রেষণে এক বছরের জন্য জাস্টিস অ্যাডভাইজার হিসেবে বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন ও উন্নয়নে কাজ করবেন। নারী বিচারকদের এই অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে দেশের বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক।
এতসব সাফল্যের পরও নারী-পুরুষের বৈষম্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের 'উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২১ ইনডেক্স' প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে সমতা, মজুরি, বিবাহ, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পদ ও পেনশন- এই আটটি সূচকের ভিত্তিতে প্রস্তুত প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সূচকগুলোতে গড়ে বাংলাদেশ যে মান অর্জন করেছে (৪৯.৪), তা পাকিস্তানের থেকেও কম (৫৫.৬)।
এদিকে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণও তেমন বাড়েনি নারীর। যেখানে ৫০ শতাংশ হওয়ার কথা, সেখানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে 'আরপিও'তে বর্ণিত শর্ত অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারীকে অন্তর্ভুক্ত করতেও দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। উত্তরাধিকারে নারীদের জন্য এখনও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বৃহদাংশই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেটিং শুরু হলেও নারী উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেট কতটা কার্যকরভাবে ব্যয় হচ্ছে, সরকারিভাবে তার কোনো অডিট হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় এখনও তথাকথিত অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে আমরা নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, অন্যদিকে নারীকে 'দাসী' ও 'ভোগের বস্তু' হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে ধর্মের নাম করে। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মসজিদের খুতবায় ও ওয়াজ মাহফিলে প্রতিনিয়ত যে বিষোদ্গার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার সমকালকে বলেন, সার্বিক বিচারে নারীর ক্ষমতায়নের অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেলেও জাতিসংঘের সিডও সনদ অনুযায়ী, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়নি এখনও। কাটেনি আইনি প্রতিবন্ধকতাও। নারীর অগ্রযাত্রায় এখনও প্রধান বাধা সহিংসতা।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, নারী-পুরুষ উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন করলেও ৫০ বছরেও বাংলাদেশের নারীসমাজ বৈষম্যমুক্ত কোনো দেশ পায়নি। এ দেশটা এখনও নারীর নিজের হয়ে ওঠেনি। এখনও নারীর অগ্রযাত্রার পথে রয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাবেক শিক্ষক জঁ দ্রেজ বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশে বেশি।'
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ সব রাজনৈতিক আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ছিল। ছিল নেতৃত্ব। নানা বাধা ভেঙে এগোচ্ছেন এবং পেশায় সফল হচ্ছেন নারী। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার পদে এবং মন্ত্রিসভাসহ উচ্চ পদগুলোতেও ঘটেছে নারীদের অন্তর্ভুক্তি। নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চ পদেও। দুই কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। ৩৫ লাখের বেশি নারী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করছেন, যেটি বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্র। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় সরকারে নারীরা সরাসরি অংশ নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকেও এগিয়েছেন।
মাধ্যমিক পর্যন্ত শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া থেকে শুরু করে মেয়েদের জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা চালু করায় করোনাকালেও বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের ভর্তির হার উন্নীত হয়েছে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশে, যেখানে ১৯৯০ সালে এই হার ছিল মাত্র ৬১ শতাংশ। অবশ্য এ দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার বেলায় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ব্যর্থতা রয়েছে প্রাথমিক স্তরের পর মেয়েশিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধেও।
নারীর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতেও। এ খাতের সবচেয়ে উজ্জ্বল অর্জন তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যা বাড়ানো। দেশে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যেও অন্যতম বাংলাদেশ। গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরিবৈষম্যও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের "ভয়েসেস টু চয়েসেস :বাংলাদেশ'স জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট" শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে। তবে চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনও কম। যদিও ২০০৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শ্রমবাজারে বাংলাদেশের নারীর অংশ নেওয়ার হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ শতাংশ।
ব্যাংকে নারীর অংশগ্রহণ :সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই দিন দিন পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এখন যারা চাকরিতে আসছেন, তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশিই নারী ব্যাংকার- আগে যা ছিল ১০ শতাংশেরও কম। অংশগ্রহণ বাড়ার পাশাপাশি নারীকর্মীদের চাকরি বদলের কিংবা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাও আগের চেয়ে কমেছে।
বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক বাদে দেশে কার্যরত অন্য ৫৯টি তফসিলি ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোতে জনবলের সংখ্যা এক লাখ ৮৩ হাজার ২০৩। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, এদের মধ্যে নারীকর্মীর সংখ্যা ২৮ হাজার ৩৭৮ জন। সে হিসাবে ব্যাংকগুলোতে নারীকর্মী ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। অন্যদিকে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৬ শতাংশ। দেশের ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ১৫ জন নারী চাকরি করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রারম্ভিক পর্যায়ে বেশি। ২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকে কর্মরত মোট নারীকর্মীর মধ্যে ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ চাকরি বদল করেছেন। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট পরিচালকদের ১২ দশমিক ২০ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী পরিচালক রয়েছেন বিদেশি মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের পরিচালকদের ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ নারী। বেসরকারি ব্যাংকের ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ পরিচালক নারী। আর রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে এ হার ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
কৃষিতে নারীর অবদান :এটি ইতিহাস-স্বীকৃত, কৃষিসভ্যতার সূচনা নারীর হাতে। এ খাতে তারা এখনও বড় রকমের অবদান রাখেন। বিশ্বের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ৮০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদিত হয় পারিবারিক কৃষি থেকে। বাংলাদেশ মূলত ক্ষুদ্র কৃষির দেশ। এখনও ৫০ শতাংশ কৃষি খামার গ্রামীণ নারীর শ্রমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ শ্রম জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কৃষিতে নারীর সংশ্নিষ্টতা ৬৮ দশমিক ৮৪ থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী মনজুন নাহার বলেন, নারীর উন্নয়নে গ্রামীণ নারী কৃষকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। গ্রামীণ নারীরা শুধু ফসল কাটার মধ্যেই সীমিত নন; বিভিন্ন চাষাবাদেও তারা যুক্ত হয়েছেন। তারা জুম, মৎস্য, জৈব কৃষিসহ নানা ধরনের কৃষির চর্চায় সহযোগিতা করছেন। নারীদের এসব উদ্যোগ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষির ২৩টি কাজের মধ্যে ১৭টি নারীরা করে থাকেন। সেখানে কৃষির প্রায় সব ধরনের কাজ রয়েছে। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও নারীরা করে থাকেন। তবে যে নারীরা এত কিছু করছেন, তারাই কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।
বিচার আসনে নারী :১৯৭৪ সালে সরকার বিচারক (মুন্সেফ) পদে নিয়োগের জন্য প্রথম দরখাস্ত আহ্বান করে কাগজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেই নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের প্রথম নারী বিচারক হন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তার পথ ধরে দেশের বিচারাঙ্গনে ন্যায়দণ্ড হাতে আলো ছড়াচ্ছেন অসংখ্য নারী বিচারক। বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ৯৮ জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ছয়জন বিচারক রয়েছেন। সেখানে কোনো নারী বিচারপতি না থাকলেও উচ্চ আদালতের ৯২ জন বিচারপতির মধ্যে নারী বিচারপতি সাতজন।
এই সাত নারী বিচারপতির মধ্যে রয়েছেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি কাশেফা হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক। বিচারপতি সালমা মাসুদ ছাড়া ছয়জন বিচারপতিই হাইকোর্টের দ্বৈত ও একক বেঞ্চে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। রিট, ফৌজদারি মোশন ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করছেন দ্রুততার সঙ্গে। দিচ্ছেন বিভিন্ন মামলায় যুগান্তকারী রায়। আর অধস্তন আদালতে কর্মরত রয়েছেন এক হাজার ৮৪৫ জন বিচারক। এর মধ্যে নারী বিচারক রয়েছেন ৫৪৪ জন, যারা জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ, যুগ্ম জেলা জজ, সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজ হিসেবে বিচারের আসনে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি চারজন নারী বিচারক গেছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। তারা সেখানে 'রুল অব ল' অ্যাডভাইজরি শাখায় প্রেষণে এক বছরের জন্য জাস্টিস অ্যাডভাইজার হিসেবে বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন ও উন্নয়নে কাজ করবেন। নারী বিচারকদের এই অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে দেশের বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক।
এতসব সাফল্যের পরও নারী-পুরুষের বৈষম্য উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের 'উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২১ ইনডেক্স' প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে সমতা, মজুরি, বিবাহ, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পদ ও পেনশন- এই আটটি সূচকের ভিত্তিতে প্রস্তুত প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সূচকগুলোতে গড়ে বাংলাদেশ যে মান অর্জন করেছে (৪৯.৪), তা পাকিস্তানের থেকেও কম (৫৫.৬)।
এদিকে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণও তেমন বাড়েনি নারীর। যেখানে ৫০ শতাংশ হওয়ার কথা, সেখানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে 'আরপিও'তে বর্ণিত শর্ত অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারীকে অন্তর্ভুক্ত করতেও দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। উত্তরাধিকারে নারীদের জন্য এখনও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বৃহদাংশই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জেন্ডার বাজেটিং শুরু হলেও নারী উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেট কতটা কার্যকরভাবে ব্যয় হচ্ছে, সরকারিভাবে তার কোনো অডিট হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় এখনও তথাকথিত অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে আমরা নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, অন্যদিকে নারীকে 'দাসী' ও 'ভোগের বস্তু' হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে ধর্মের নাম করে। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মসজিদের খুতবায় ও ওয়াজ মাহফিলে প্রতিনিয়ত যে বিষোদ্গার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার সমকালকে বলেন, সার্বিক বিচারে নারীর ক্ষমতায়নের অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেলেও জাতিসংঘের সিডও সনদ অনুযায়ী, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়নি এখনও। কাটেনি আইনি প্রতিবন্ধকতাও। নারীর অগ্রযাত্রায় এখনও প্রধান বাধা সহিংসতা।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, নারী-পুরুষ উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীন করলেও ৫০ বছরেও বাংলাদেশের নারীসমাজ বৈষম্যমুক্ত কোনো দেশ পায়নি। এ দেশটা এখনও নারীর নিজের হয়ে ওঠেনি। এখনও নারীর অগ্রযাত্রার পথে রয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা।
মন্তব্য করুন