ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ও উপহার মিলে এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসের টিকা এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ। এর মধ্যে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারাদেশে ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৩ জন প্রথম ডোজ নিয়েছেন। সমসংখ্যক মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের হাতে মজুদ আছে ৪৬ লাখ ৩১ হাজার ২৯৭ ডোজ। ঘাটতি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৪০৬ ডোজ। এর মধ্যেই আবার ভারত সরকার রপ্তানি স্থগিত করায় টিকা পাওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এমন পরিস্থিতিতেই আজ বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান কার্যক্রম। একই সঙ্গে প্রথম ডোজের টিকাদান কর্মসূচিও অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে গতকাল বুধবার বিকেলের মধ্যে সারাদেশে টিকা পৌঁছে গেছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিন যারা টিকা নিয়েছিলেন, আজ তারা সবাই দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাবেন। তবে অনেকে বলেছেন, ভারত থেকে সময়মতো টিকা না এলে প্রথম ডোজ নেওয়া মানুষ বিপদে পড়বে। সুতরাং সরকারের উচিত প্রথম ডোজ বন্ধ রেখে দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা। আবার কেউ কেউ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ভেবেচিন্তেই ওই ঘোষণা দিয়েছেন। টিকা পাওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নির্ধারিত সময়েই টিকা চলে আসবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, কেনা টিকার ৩০ লাখ ডোজ এপ্রিলের মধ্যে সরবরাহের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ওই টিকা পৌঁছাবে বলে আশা করা যায়।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে নির্ধারিত সময়ে টিকা না এলে পরিকল্পনা কী হবে কিংবা বিকল্প কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, টিকার বাংলাদেশে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তারাও টিকা পাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। আমরা তাদের আশ্বাসে আস্থা রাখতে চাই। এর পরও টিকা না এলে প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তখন কেবল দ্বিতীয় ডোজ চলবে। একই সঙ্গে টিকার বিকল্প উৎস খোঁজা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চীন, রাশিয়া ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কেনার জন্য একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং টিকা নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, এটি সাময়িক।
যে কারণে অনিশ্চয়তা :সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকার রপ্তানি গত ২৪ মার্চ সাময়িকভাবে স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। ওই ঘোষণায় বাংলাদেশও টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে আগামী এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত টিকা রপ্তানি বিলম্বিত হতে পারে। ভারতের রপ্তানি স্থগিতের সিদ্ধান্তের কারণে ১৮০টি দেশ টিকা পাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, মার্চ ও এপ্রিলে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য যে টিকার চালান সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে পাঠানোর কথা ছিল, রপ্তানির অনুমোদন না মেলায় তাও সরবরাহ বিলম্ব হবে। বাংলাদেশেরও আগামী মে মাসের মধ্যে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল। সেই টিকা পাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ডের টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে গত বছরের নভেম্বর মাসে সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, কেনা টিকার তিন কোটি ডোজের মধ্যে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে আসার কথা। কিন্তু জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়া পর ফেব্রুয়ারিতে আসে ২০ লাখ ডোজ। ৩০ লাখ ডোজ কম আসে। মার্চ মাসে কোনো টিকা আসেনি। ধারণা করা হচ্ছে, এপ্রিলেও টিকা আসবে না। এর মধ্যেই ভারত সরকার টিকা রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে টিকার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিকার বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছেন। সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পর টিকা নিয়ে বাংলাদেশের অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। শিগগিরই টিকা পাবে বাংলাদেশ।
বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ : শুরুতে চীনের সিনোভ্যাক টিকার ট্রায়াল করতে চেয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি। রাশিয়াও তাদের তৈরি স্পুটনিক টিকা বাংলাদেশকে দিতে রাজি হয়েছিল। এই দুটি দেশই প্রয়োজনে কাঁচামাল সরবরাহ করে বাংলাদেশে টিকা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যেই ভারত সরকার টিকার বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদন করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। ওই টিকার তিন কোটি ডোজ পেতে সরকার, বেক্সিমকো ফার্মা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সরকার টিকার আর বিকল্প উৎসের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে। আর ভারত থেকে টিকা কেনার কারণে রাশিয়া ও চীনও পিছিয়ে যায়। কিন্তু এখন ভারতের টিকা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে চীন ও রাশিয়ার টিকা পেতে যোগাযোগ শুরু করা হয়েছে। এর বাইরেও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকাও পেতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ইউএনডিপির অর্থায়নে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এই টিকা আগামী সেপ্টেম্বরের আগে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে টিকার উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামালের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে এবং ওষুধ শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে অন্য কয়েকটি টিকার উদ্ভাবকদের কাছে চিঠি দিলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
আগেই বিকল্প উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, টিকা নিয়ে একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বিপদ ডেকে আনতে পারে- শুরু থেকে এটি বলে এসেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। এখন কিন্তু টিকা নিয়ে বিপদেই পড়েছি।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, যাদের প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হলো, তাদের দ্বিতীয় ডোজও দিতে হবে। কিন্তু সেই পরিমাণ মজুদ সরকারের কাছে নেই। এখন টিকা না এলে কী হবে? এজন্যই একটি দেশের ওপর নির্ভর করা যৌক্তিক হয়নি।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, আরও অন্তত দুটি উৎস থাকলে তখন একটি উৎস থেকে টিকা না পেলেও সমস্যা হতো না। কারণ অপর উৎস থেকে টিকা আসত। অনেক দেশ একই সঙ্গে দুই থেকে তিন ধরনের টিকা বিতরণ করছে। তাদের সমস্যা হচ্ছে না। ব্রাজিল চীনের টিকা দিচ্ছে আবার ভারতের সেরাম থেকে অক্সফোর্ডের টিকাও কিনছে। সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্কসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ এই পথে হাঁটছে। সুতরাং বাংলাদেশও এটি করতে পারত। তাহলে এখন দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, টিকা পেতে একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কেনার পাশাপাশি কাঁচামাল এনে দেশে টিকা উৎপাদনের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ল্যাবটি টিকা উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বেসরকারি একটি বড় ওষুধ কোম্পানি আন্তর্জাতিক মানের একটি ল্যাব তৈরি করেছে। কাঁচামাল পেলে ওই ল্যাবেও টিকা উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এর বাইরে জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীন ও রাশিয়ার টিকা কিনতেও একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কোনো একটি উৎস থেকে টিকা পাওয়া সম্ভব হবে।