করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলা সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের তৃতীয় দিন থেকে মহানগরীতে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের চিত্র ছিল একেবারেই নাজুক। যেসব শর্ত অনুসরণ করে গণপরিবহন চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, বেশিরভাগ পরিবহনই তা মেনে চলেনি। অর্ধেক আসন খালি রাখার যে বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছিল, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল অনুপস্থিত। অনেক যাত্রীর, বাস কন্ডাক্টর, হেলপারকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। জীবাণুনাশক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। রাজধানীর চেহারা ছিল যানজটের ঢাকার মতোই। যদিও যাত্রীর উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। সন্ধ্যা ৬টার পর গণপরিবহন চলাচলের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বেশিরভাগ পরিবহন তা অনুসরণ করেনি। রাত পর্যন্ত গণপরিবহন চলতে দেখা গেছে। ট্রাফিক বিভাগেরও এ ব্যাপারে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
গণপরিবহন চলাচলে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলেও রাইড শেয়ার চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় মোটরসাইকেল চালকরা কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের প্রশ্ন, গণপরিবহন, প্রাইভেটকার চললে মোটরসাইকেল কেন চলতে পারবে না।
এদিকে দোকান খোলা রাখার দাবিতে গতকালও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন দোকান মালিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, লকডাউনের কথা বলে দোকানপাট বন্ধ রাখা হচ্ছে। কিন্তু পরিবহন খুলে দেওয়া হলো। ব্যবসায়ীরা গত এক বছরে পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন দোকান খুলতে না দিলে না খেয়ে মরতে হবে।
সরকারের নির্দেশনায় ঢাকায় বাইরে থেকে কোনো যানবাহন ঢুকতে ও বের হতে দেওয়া হবে না বলে বিধিনিষেধ ছিল। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বচসার ঘটনা ঘটে। তারা বলেন, অনেক বাস আছে গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ চলাচল করে। কিন্তু টঙ্গীতে পৌঁছালেই সেসব যানবাহনকে পুলিশ আটকে দেয়। ফলে ওই সব পরিবহনের যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। একই ঘটনা ঘটে আমিনবাজার ও বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায়। এসব বচসার পর কিছু পরিবহন চলার সুযোগও দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গণপরিবহনে বিধিনিষেধ অমান্য প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যেসব বিধিবিধান অনুসরণ করে গণপরিবহন চলাচলের সুযোগ সরকার দিয়েছে, সেসব অনুশাসন গণপরিবহনে মানা হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থার। এ ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক সমিতির কিছু করার থাকে না।
লোকাল বাসগুলোতে আসন সংখ্যার চেয়েও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। এমনকি সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির কথা বললেও বাসগুলো দ্বিগুণ ও তিন গুণ ভাড়া আদায় করেছে। এ নিয়েও যাত্রীদের সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টরদের বচসার ঘটনা ঘটেছে। জানতে চাইলে আলিফ পরিবহনের চালক
ইমরান বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছি। অর্ধেকের বেশি যাত্রী পরিবহন করছি না। ভাড়া ৬০ শতাংশেরও বেশি নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীরা জোর করে বাসে উঠে পড়ছে। তখন তাদের নামানো যাচ্ছে না।
দিশারী পরিবহনের যাত্রী শাহীন জানান, মিরপুর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। এখন ৪০-৫০ টাকা নিচ্ছে। আফসানা মীম নামে আরেক যাত্রী বলেন, গুলিস্তান থেকে শ্যামলী পর্যন্ত যেতে অন্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া রাখছে বাসগুলো।
একটা ট্রিপ শেষ হওয়ার পর পুরো বাস জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে করার কথা থাকলেও কোথাও সেই দৃশ্য চোখে পড়েনি। সহকারীর (হেলপার) কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকার কথা বলা হলেও কারও হাতেই সেটা দেখা যায়নি। এমনকি মাস্ক থাকলেও সেগুলো থুতনিতে রেখে যাত্রী হাঁকডাক করতে দেখা গেছে। হেলপাররা বলেন, মাস্ক মুখে থাকলে যাত্রীদের ডাকা যায় না। আর প্রচণ্ড গরমে মাস্ক ভিজে যায়। মনে হয় দমবন্ধ হয়ে যাবে।
খাবার রেস্টুরেন্টগুলোতে বসে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেই তা মানা হয়নি।
ভ্রাম্যমাণ আদালত :নগরবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলাচল নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালায়। মিরপুর ১৪ নম্বরে মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরির দায়ে সাতজনকে ৭০০ টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। কারওয়ান বাজারে একই অপরাধে ৫৪ জনকে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা করা হয়। উত্তরা হজক্যাম্প ও দক্ষিণখানে বিধিনিষেধ অমান্য করে খাবার পরিবেশন করায় পাঁচটি রেস্টুরেন্টকে ৪১ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বীর আহমেদ। ভাটারায় সাতটি খাবার রেস্টুরেন্টকে ১০ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয়।