- বাংলাদেশ
- ব্যাংকে উপেক্ষিত ছোট উদ্যোক্তারা
ব্যাংকে উপেক্ষিত ছোট উদ্যোক্তারা
পাঁচ দফা সময় বাড়িয়েও প্রণোদনার ঋণ বিতরণ শেষ হয়নি
সরকারি প্রণোদনার আওতায় ৫০ লাখ টাকা ঋণের জন্য বেসরকারি একটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর আবেদন করে ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানা লিমিটেড। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট থাকলেও আজ-কাল করে প্রায় চার মাস পর গত ৬ জানুয়ারি শাখা থেকে ঋণ অনুমোদনপত্রে প্রতিষ্ঠানটির এমডির সই নেয় ব্যাংক। এর আগেই ঋণের বীমাসহ খরচ বাবদ নেওয়া হয় ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু গত ১৫ মার্চ ব্যাংক থেকে মৌখিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে জানানো হয়, ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়।
দেশের ফ্যাশন জগতে বহুল পরিচিত ব্র্যান্ড বিবিয়ানা। তারপরও প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেওয়া হয়নি ব্যাংক থেকে। বরং টানা ছয় মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাহলে নাম না জানা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক কী ধরনের আচরণ করে, তা সহজেই অনুমেয়। নিজের পুঁজি খাটিয়ে অনেক কষ্টে একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করলেও ঋণ না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন, এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক।
কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার গত বছরের এপ্রিলে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে। প্রথমে আগস্টের মধ্যে পুরো ঋণ বিতরণ শেষ করতে বলা হয়। পরে পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে বিতরণ শেষ করতে বলা হয়। তবে এ পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ১৪ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা বা ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ। গতকাল সোমবার এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ শেষ করার সময়সীমা ষষ্ঠবারের মতো বাড়িয়ে জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের একই সময়ে বড় শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে সরকার। ব্যাপক চাহিদার কারণে এর পরিমাণ বাড়িয়ে প্রথমে ৩৩ হাজার কোটি টাকা, পরে আরও সাত হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। দুটি তহবিল থেকেই ব্যাংকগুলো বর্তমানে নির্ধারিত ৯ শতাংশ সুদ পাচ্ছে। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতে সরকার ৫ শতাংশ এবং বড় উদ্যোক্তাদের ঋণে সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে।
বিবিয়ানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিপি খন্দকার সমকালকে জানান, তাকে ছয় মাস ঘুরিয়ে ব্যাংক এখন বলছে, ঋণ দেবে না। এটা তার জন্য একটা ভয়ানক অভিজ্ঞতা। প্রণোদনার আওতায় ঋণের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে আবেদনের পর ব্যাংক বারবার সময় নিয়েছে। সব শেষে ঋণ অনুমোদনপত্রে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ঋণ দেবে বলেই বীমাসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৫৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। অথচ ছয় মাসের বেশি কালক্ষেপণ করে জানানো হয়, ঋণ দেওয়া হবে না। ফ্যাশন হাউসগুলোর ব্যবসার বড় বিনিয়োগই হয় ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে। তাই বিষয়টি শুরুতেই জানিয়ে দিলে তিনি বিকল্প ভাবতেন।
সিএমএসএমই খাতে মোট ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না অধিকাংশ ব্যাংক। গত বছর বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বা তিন দশমিক ৫১ শতাংশ দেওয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের। আগের বছরের তুলনায় নারীদের মধ্যে বিতরণ কমেছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণের অংশ ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমে ১৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। গ্রামাঞ্চলে বিতরণ সাত দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাত ব্যাপক পিছিয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম ভূমিকা রাখছে এ খাত। সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এসএমই খাতের মাধ্যমে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীক্ষা অনুসারে, দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে।
করোনাভাইরাসে ক্ষতির প্রভাব নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি জরিপ করে বিশ্বব্যাংকের আইএফসি এবং যুক্তরাজ্যের এফসিডিও। সেখানে উঠে আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নগদ প্রবাহের সংকটে পড়েছে। এ খাতের ৯৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ব্যাপক কমেছে। ৩৭ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছেন। সিএমএসএমই খাতে এমন খারাপ অবস্থা দেখা দিলেও ঋণ বিতরণে পুরোনো পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ অনেক পুরোনো। করোনার এ সময়ে তা আরও বেশি শোনা যাচ্ছে। অথচ হয়রানি ও কালক্ষেপণ ছাড়া এসব উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়ে এগিয়ে নিতে পারলে উৎপাদন এবং চাহিদা আরও বাড়বে। ছোট একটি উদ্যোগে পাঁচজনের কর্মসংস্থান হলেও তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। এসব না করে শুধু আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে লম্বা-লম্বা কথা বলে কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে যেসব ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি, তাদের ধরে ধরে চিঠি দিতে হবে। এরপরও অর্জন না হলে নতুন শাখার অনুমোদন কমানোসহ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সুযোগ-সুবিধা কমাতে হবে। ছোটরা না এগোলে শুধু বড়দের দিয়ে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়।
সংশ্নিষ্টরা জানান, করোনার কারণে গত বছরের রোজা ও দুই ঈদে ব্যবসা ভালো যায়নি। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। তবে প্রথম ধাক্কার অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভালো ব্যবসা হবে এমন আশায় অনেক প্রতিষ্ঠান আগাম প্রস্তুতি নিয়েও টাকার অভাবে হোঁচট খাচ্ছে। ঋণ চেয়েও না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকে।
প্রণোদনার আওতায় সিএমএসএমই খাতে সামগ্রিকভাবে ৭২ দশমিক ৩১ শতাংশ ঋণ বিতরণ হলেও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ শেষ করেছে। প্রথমে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা শেষ করে নতুন করে দুই বার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, দেশের জিডিপির ২৫ শতাংশের বেশি আসে এসএমই খাতের মাধ্যমে। ৭০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান ঘটছে এ খাতে। ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যত দ্রুত ঋণ দেওয়া যাবে, তত দ্রুত তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ লক্ষ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার শুরু থেকেই কৃষি ব্যাংক অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা প্রতিটি শাখায় ভাগ করে দিয়েছে। প্রতিদিনই এসবের নিয়মিত তদারকির জন্য একটি সফটওয়্যারও উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো শাখা পিছিয়ে থাকলে তার কারণ জানতে চাওয়া হয়। এসব কারণে প্রথমে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা শেষ করে পরে আবার দুই দফা লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের মতো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা সিএমএসএমই খাতের। প্রতিটি ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ এ খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। এরপরও একজনকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে বেশি মুনাফা করার মানসিকতা থেকে ব্যাংক এখনও বের হতে পারেনি। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। অবশ্য কয়েক বছর আগের তুলনায় পরিস্থিতির সামান্য হলেও উন্নতি হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে।
মন্তব্য করুন