বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দান ও চাঁদার টাকায় চলে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো। রমজান মাসই হচ্ছে তাদের চাঁদা আদায়ের সবচেয়ে ভালো সময়। সাধারণত রমজানে ধর্মপ্রাণ মানুষ দু'হাতে দান করে থাকেন। কওমি মাদ্রাসাগুলো সেই সুযোগটিই কাজে লাগায়। এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আসে। প্রতিবছর রমজান মাসে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ বড় বড় মাদ্রাসাগুলোর নির্ধারিত কিছু আলেম-শিক্ষক ফান্ড সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন। তাদের অনেকে পাড়ি জমান বিদেশে। বৈধ চ্যানেলের পাশাপাশি অবৈধ চ্যানেলেও টাকা আসে।
অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের আয়ের উৎস নিয়ে রয়েছে রহস্য। শুভাকাঙ্ক্ষীদের চাঁদার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হেফাজতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ধর্মীয় সংগঠনটি কর্মসূচি পালনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তার বড় একটি অংশ আসে 'সুবিধাভোগী' বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে। এ ছাড়া হেফাজতে থাকা বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ও দলগুলোর নেতারা হেফাজতের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থায়ন করে থাকেন।
জানা যায়, বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ ছাড়াও বছরের তিনটি সময় কওমি মাদ্রাসাগুলো বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে মাদ্রাসা মাদ্রাসায় বার্ষিক মাহফিল, কোরবানির ঈদে পশুর চামড়া, নগদ অর্থ সংগ্রহ ও রমজানে জাকাতের অর্থ। এর বাইরে ছাত্র-শিক্ষকদের দিয়ে বছরজুড়ে এলাকাভিত্তিক অর্থ ও চাল সংগ্রহ চলে।
হেফাজতে ইসলাম ও কওমিদের মূল ঘাঁটি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটিতে ৮ থেকে ৯ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ছাত্রকে 'লিলল্গাহ বোর্ডিং' থেকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আরও বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে বিনামূল্যে লেখাপড়া করানো হয়। সরকার থেকে তেমন কোনো অনুদান পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ মাদ্রাসা পরিচালনায় কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় মূলত দেশ-বিদেশ থেকে আসা চাঁদার টাকায়।
কওমি মাদ্রাসার আয়ের উৎস নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক জুনায়েদ বাবু নগরী বলেন, 'কওমি মাদ্রাসার আয়ের উৎস জনগণের টাকা। আমরা জনগণের টাকায় চলি। এদেশের জনগণ মাদ্রাসাকে নিজেদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাই সরকারি কোনো অনুদান আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা গ্রহণও করি না।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রমজানে স্থানীয়ভাবেও বিপুল অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে থাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহে বেশ কয়েকজন শিক্ষক প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমান। মাদ্রাসাটির শিক্ষক মাওলানা শেখ আহমদ, ড. মাওলানা নুরুল আবছার, মাওলানা মো. মাইনুদ্দিন, মাওলানা মো. বশির আহমদ ও মাওলানা মো. শোয়াইবসহ কয়েকজন পরিচিত মাদ্রাসা শিক্ষক ও প্রভাবশালী হেফাজত নেতা অর্থ সংগ্রহে মুসলিমপ্রধান দেশ, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে যান। মাওলানা শেখ আহমদ যান দুবাই-আবধাবি; মাওলানা নুরুল আবছার সৌদি আরব; মাওলানা মাইনুদ্দিন মালয়েশিয়া; মাওলানা বশির আহমদ ওমান এবং মাওলানা শোয়াইব কাতার থেকে ফান্ড সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। রমজান শুরু হলেই তারা বিদেশে যেতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে দুবাই চলে গেছেন মাওলানা শেখ আহমদ। অন্যদের বিদেশে যাওয়ার কথা থাকলেও লকডাউনে অন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে তাদের যাওয়া বিলম্বিত হচ্ছে। শুধু হাটহাজারী মাদ্রাসাই নয়, হাটহাজারীর অন্যান্য কওমি মাদ্রাসাও বিদেশ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। যেমন হাটহাজারী গড়দুয়ারা মাদ্রাসার মুহতামিম (মহাপরিচালক) মাওলানা মো. ইদ্রিস, ফতেহপুর মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মাহমুদুল হাসান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করেন। দেশের অন্যান্য বড় কওমি মাদ্রাসা থেকেও অর্থ সংগ্রহের জন্য এভাবে বিদেশে গিয়ে থাকেন। সাধারণত প্রবাসী লোকজন সওয়াবের আশায় ধর্মীয় শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে মাদ্রাসায় মোটা অঙ্কের চাঁদা কিংবা অনুদান দিয়ে থাকেন। কওমি মাদ্রাসাগুলো নিজস্ব উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। প্রত্যেক বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে বৃহস্পতি-শুক্রবার হাটহাজারী মাদ্রাসায় বার্ষিক মাহফিল হয়। মাহফিলে কওমি, কওমিভক্তসহ ধর্মপ্রাণ অনেক সাধারণ মানুষও মাদ্রাসা পরিচালনায় দান করে থাকেন। বিশেষ করে, চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিত্তবান লোকজন মাদ্রাসার জন্য দান করে থাকেন। এই মাহফিলে কয়েকশ গরু-ছাগল ছাড়াও কোটি কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। রোজার ঈদেও বিপুল পরিমাণে নগদ অর্থ পাওয়া যায়। এ ছাড়া কোরবানির ঈদে হাটহাজারীসহ আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার পশুর চামড়া আসে। সর্বশেষ গত বছরের কোরবানির ঈদে মাদ্রাসাটি প্রায় ১৫ হাজার গরু-মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে।
এদিকে, হেফাজতের আয়ের উৎস কখনও প্রকাশ করে না সংগঠনটি। কওমিভক্ত বিত্তবান লোকজন চাঁদা হিসেবে এই অর্থ দেন বলা হলেও বাস্তবে এর বাইরেও আয়ের বিভিন্ন খাত রয়েছে। বিশেষ করে 'সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ' বিভিন্ন ইস্যুতে দেওয়া কর্মসূচি সফল করতে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, সেটা একাধিক উৎস থেকে আসে। সুবিধাভোগী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। এ ছাড়া হেফাজতে বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা যুক্ত রয়েছেন, তারাও অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন।
হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর অনুসারী ও সংগঠনটির একাংশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহী সমকালকে বলেন, 'বর্তমানে তথাকথিত হেফাজতের যে কমিটি রয়েছে তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট, আদর্শহীন। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ফায়দা নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে।'