- বাংলাদেশ
- ভারতফেরতদের নিয়ে চতুর্মুখী সংকট
ভারতফেরতদের নিয়ে চতুর্মুখী সংকট

ভারতের করোনা পরিস্থিতি ভীতি ছড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে যে কোনো সময় এখানেও ভারতের মতো অবস্থা তৈরি হতে পারে বলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ২৬ এপ্রিল থেকে স্থলসীমান্ত বন্ধ রয়েছে। তবে এরই মধ্যে চিকিৎসার জন্য গিয়ে আটকেপড়া বা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে আসা বাংলাদেশিরা স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ঢোকার অনুমতি পাচ্ছেন। এ সুযোগে গতকাল সোমবার পর্যন্ত তিন হাজার ৬৬৬ জন ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী ভারতফেরতদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু যেসব স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশিরা প্রবেশ করছেন, সেখানে তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করাসহ চতুর্মুখী সংকটে স্থানীয় প্রশাসনে হিমশিম খাচ্ছে।
শুরুতে বেনাপোল, আখাউড়া ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশের সুবিধা ছিল। গত রোববার থেকে কুষ্টিয়ার দর্শনা, দিনাজপুরের হিলি ও রাজশাহীর সোনামুখী দিয়েও লোকজন ভারত থেকে দেশে ফিরছেন। দেশে ফেরত আসা কারও কারও এরই মধ্যে কভিড-১৯ ধরা পড়লে এখনও অনেকের করোনার ধরন শনাক্ত করা যায়নি। এতে ভাইরাসের ধরন নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। এ ছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতফেরত যারা দেশে ঢুকছেন, সেখানে কোয়ারেন্টাইনে জায়গা সংকটের কারণে দূর-দূরান্তের অনেক জেলায় তাদের রাখতে হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে তাদের অন্যান্য জেলায় নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য প্রশাসনের কাছে পরিবহন ও অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্টও পর্যাপ্ত নেই। স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনের কম রয়েছে- এমন লোকজন দেশে ফিরে আসছেন। কিন্তু এতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করছে। ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে দেশে ফিরতে আগ্রহী বাংলাদেশিদের দিল্লি, কলকাতা ও আগরতলার বাংলাদেশ মিশনের অনাপত্তিপত্র নিতে হয়।
যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার সমকালকে বলেন, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৮০২ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এসেছেন ৪৯ জন। তাদের অর্ধেককে যশোর ও বেনাপোলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। বাকিদের খুলনা, সাতক্ষীরা, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়।
খুলনা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন সমকালকে বলেন, ভারতফেরতদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা অনেক কঠিন হচ্ছে। যশোর জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এ জন্য খুলনা বিভাগের অন্যান্য জেলায়ও তাদের কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে।
যশোরের পুলিশ সুপার আরও বলেন, পুলিশি নিরাপত্তায় গাড়ি দিয়ে ভারতফেরতদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কারও কিছু দরকার হলে হটলাইনে ফোন করলে পৌঁছে দেওয়া হয়। অবস্থাসম্পন্নরা নিজেরাই কোয়ারেন্টাইনের সময় খরচ বহন করছেন। তবে আর্থিক সংকটে থাকাদের সহায়তা করছে প্রশাসন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান সমকালকে বলেন, স্থলসীমান্ত বন্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ৬৬২ জন দেশে প্রবেশ করেন। এ জেলায় ৩০০ জনকে একসঙ্গে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা আছে। বাকিদের অন্যত্র রাখা হচ্ছে। আখাউড়া দিয়ে ফেরত আসা দু'জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়। ভাইরাসের ধরন শনাক্তেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ভারতফেরতেদের হোটেল বা অস্থায়ী নতুন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখার পাশাপাশি সরকার তাদের জন্য ছয়টি হাসপাতালেরও ব্যবস্থা করেছে। বিশেষ করে ভারতফেরত অসুস্থদের কিডনি হাসপাতাল ও আজগর আলী, ক্যান্সার হাসপাতালসহ এসব হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে কোয়ারেন্টাইনকাল সম্পন্ন হওয়ার পর দ্রুত করোনা টেস্টের ফল না পাওয়ায় অনেকের মধ্যে অসন্তোষ আছে।
যশোরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আসা এক হাজার ১৭০ জন কোয়ারেন্টাইন শেষে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে আছেন এক হাজার ৬৩২ জন। এ জেলার সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, পিসিআর টেস্টের রিপোর্ট দ্রুত পাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, ভারতফেরত রাজিব সাহা (৩৪) ও সুস্মিতা সাহা (২২) দম্পতি যশোরে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন শেষে বাড়ি ফেরার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল পিসিআর টেস্টের ফল পজিটিভ হওয়ার পর তাদের যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যশোর শহরের বেজপাড়া মেইন রোড এলাকার বাসিন্দা এই দম্পতি শহরের ম্যাগপাই হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। গত ২৯ এপ্রিল তারা বেনাপোল বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন। কোয়ারেন্টাইন শেষে ১৩ মে ছাড়পত্র নিয়ে তারা বাড়িতে যান। সেখানেই তাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এদিকে লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা ভারতফেরত তিন বাংলাদেশি স্কুল শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। রোববার রাতে ওই তিন শিক্ষার্থীর করোনা পজিটিভ আসে। গত ২ মে বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে তারা দেশে আসে। ওই তিন শিক্ষার্থী ভারতের দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে পড়ছে।
বুড়িমারী স্থলবন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত এ বন্দর দিয়ে ২০২ জন বাংলাদেশি এসেছেন। কোয়ারেন্টাইন শেষে করোনা নেগেটিভ হওয়ায় গত চার দিনে তাদের ২৬ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন নির্মলেন্দু রায় জানান, রংপুর পিসিআর ল্যাবে ভারতফেরত ৩৬ বাংলাদেশির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। রোববার রাতে তাদের তিনজনের করোনা শনাক্ত হয়। তবে তাদের মাঝে করোনার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। তাদের শরীরে ভারতীয় ধরন রয়েছে কিনা তা জানার জন্য গতকাল ঢাকায় নমুনা পাঠানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ভারতফেরত বাংলাদেশিদের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা ছাড়াও পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও হেলপারদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন পণ্য নিয়ে শত শত ট্রাক ঢুকছে বাংলাদেশে। এসব ট্রাকের চালক ও হেলপাররা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি করায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। আবার বাংলাদেশের চালক ও হেলপাররা প্রতিনিয়ত ভারতে যাচ্ছেন। তারাও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ভারতে গিয়ে চলাফেরা করছেন। এ নিয়ে স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত।
করোনা-সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সমকালকে বলেন, ভারত সীমন্ত বন্ধ করায় মানুষের আসা-যাওয়া অনেক কমেছে। এর পরও যারা ভারত থেকে ফিরবে তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া পণ্যবাহী যানবাহনের চালক ও হেলপারদের অন্য মানুষের সংস্পর্শে না আসাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পরও মাঝমধ্যে প্রশাসনের উদাসীনতার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জন্য অবশ্যই বিধিনিষেধ পুরোপুরি মানতে হবে।
তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুরুতে বলা হয়েছিল চালক ও হেলপারদের জন্য আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করা হবে। নির্দিষ্ট স্থানে খাওয়া-দাওয়া করবে। কিন্তু এসব বিষয় না মানলে ভারতের ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক ও হেলপারকে নির্দিষ্ট হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের অন্য কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা তাদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন তারাও অন্য মানুষের সঙ্গে মিশছেন না। আর বাংলাদেশ থেকে যেসব চালক ও হেলপার ভারতে যাচ্ছেন তারা সেখানে নামছেন না। মাল রেখে সরাসরি ট্রাকে বসে থেকেই দেশে ফিরছেন। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ভারতফেরতদের কেউই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চান না। এ অবস্থায় তারা নানা দোষত্রুটি ধরার চেষ্টা করেন। এটা ভালো নয়, ওটা ভালো নয়, বাথরুম পরিস্কার নয়, মশাসহ আরও নানা অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করেন। আরও একটা সমস্যা হচ্ছে হোটেল খরচ। শেষ পর্যন্ত যশোর জেলা প্রশাসন হোটেল ও অন্যান্য খরচ ৫০ ভাগ কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করলে তারা সাড়া দিচ্ছেন।
কোয়ারেন্টাইন থেকে ১০ রোগী পালিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে সাতজন ভারতফেরত ও বাকিরা স্থানীয়। পরে তাদের খুঁজে হাসপাতালে ফিরিয়ে এনেছে যশোর জেলা প্রশাসন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছে যশোর অফিস ও লালমনিরহাট প্রতিনিধি
মন্তব্য করুন