
অতীতে দেখা গেছে যে কোনো ঝড়ের সময় জনবসতি আগলে রেখে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে দেয় সুন্দরবন। এবারও শেষ ভরসা ছিল সুন্দরবন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনে বড় ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মারা গেছে হরিণ। জোয়ারে ভেসে আসা এই হরিণ দুটি জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ, বাগেরহাটের কর্মীরা - সমকাল
ঝড়ের সময় জনবসতিকে আগলে রেখে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেয় সুন্দরবন। এবারও ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানলে শেষ ভরসা ছিল সুন্দরবনই। ভারতে তাণ্ডব চালিয়ে ইয়াস চলে গেলেও বাংলাদেশকে সেভাবে বিধ্বস্ত করেনি। তবে রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। দেশের ৯টি জেলার ২৭ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের আঁচড় লেগেছে। পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। নিজের ক্ষতি সয়ে যে সুন্দরবন অতীতে দেশের উপকূলবাসীকে আরও বেশি ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করেছে, সেই সুন্দরবনেও এবার ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। বন থেকে জোয়ারের পানিতে একে একে লোকালয়ে ভেসে এসেছে চারটি মৃত হরিণ। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুটি হরিণ। জলোচ্ছ্বাসে বনের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। নোনাপানির প্লাবনে মাছের ঘের, গবাদি পশু ও মাঠের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
বন বিভাগ সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আক্রান্ত জেলাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চাওয়া হয়েছে। হিসাব চূড়ান্ত করতে আরও সপ্তাহ খানেক লাগবে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস গত বুধবার সকালে ভারতের ওডিশা রাজ্যে আঘাত হানার পর ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর ক্ষতি করেছে। গত বছর করোনাকালে আম্পানের ধাক্কা সামলানোর আগেই আবার জলোচ্ছ্বাসের আঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে উপকূলের মানুষকে। প্রাথমিকভাবে সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সব হিসাব উপস্থাপন করার পর চূড়ান্ত তথ্য জানানো হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা তথ্য পেয়েছি অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার মানুষের সহায়তায় সাড়ে ১৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মৎস্যজীবী যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হবে। যাদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সরবরাহ করা হবে।
সুন্দরবনে বড় ক্ষতির আশঙ্কা :সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে চারটি কমিটি করা হয়েছে। সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের অন্তর্গত শরণখোলা, চাঁদপাই রেঞ্জ, খুলনা জেলার নলিয়ান ও সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে চারটি মৃত ও দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালাসহ পূর্ব বন বিভাগের ১৯টি জেটি, ছয়টি জলযান, দুটি রেস্ট হাউস, একটি ব্যারাক, একটি গোলঘর, ১০টি অফিস ও স্টেশনে টিনের চালা উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে দুটি টাওয়ার, ২৪টি পাটাতনের রাস্তা। ৯টি মিষ্টিপানির পুকুরে নোনাপানি ঢুকে পড়েছে। বনের মধ্যে আর কোনো বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের প্রভাবে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এর প্রভাবে বনের অভ্যন্তরে লবণ পানি প্রবেশ করছে। প্রজনন কেন্দ্রে কুমিরের শেডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে এত পানি আমি আগে কখনও দেখিনি। এমন অবস্থায় সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে প্রাথমিকভাবে ৬০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্নিষ্ট সব অফিসের আওতাধীন বনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বনরক্ষীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সমকালের বাগেরহাট, শরণখোলা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, গত বুধবার দুপুরে দুবলা থেকে একটি, কচিখালী থেকে একটি, শরণখোলা উপজেলা সদরের বলেশ্বর নদীর রাজেস্বর এলাকা থেকে একটি ও গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চাল রায়েন্দা এলাকা থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়। মৃত হরিণগুলো মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মঠবাড়িয়ার বেতমোড় ও গোলবুনিয়ার লোকালয়ে চলে যাওয়া দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
কৃষি ও মাছের ক্ষতি : জলোচ্ছ্বাসে ফসল, মাছের ঘের ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। বিশেষ করে সবজির ক্ষতি উদ্বেগজনক। অন্যদিকে দেশের ৯টি উপকূলীয় জেলার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায়। জলোচ্ছ্বাসের কারণে সেখানকার মাছের ঘের থেকে প্রচুর মাছ ভেসে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ভেসে গেছে গবাদি পশু। কৃষি ও মাছের ক্ষতির হিসাবও এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আমরা মাঠে নির্দেশনা দিয়েছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা এটার মূল্যায়ন করছেন। কাল-পরশুর মধ্যে মোট ক্ষতির হিসাব পেয়ে যাব।
তিনি বলেন, ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। কিছু শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক বা বড় কোনো ফসলের ক্ষতি হয়নি বলে আশা করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, জেলার রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া, গলাচিপা, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, দুমকী, বাউফল ও সদর উপজেলার সাত হাজার ৮৫টি ঘের ও পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, চিংড়ি ও পোনা জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাঙ্গাবালী উপজেলায়। এ উপজেলার ৯০ ভাগ ঘের ও পুকুরের সব মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। এতে জেলায় মোট ক্ষতি হয়েছে ৫৫ কোটি চার লাখ ২৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৫৫ লাখ ২৫ হাজার, চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, পোনার ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি দুই হাজার টাকা এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে তিন কোটি ৫১ লাখ টাকার।
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি জানান, রামগতির চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর জোয়ারের পানিতে দুই শতাধিক গবাদি পশু ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন জানিয়েছেন, গবাদি পশুগুলো উদ্ধারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। গবাদি পশু আশ্রয়ের জন্য চরে মাটির কিল্লা নির্মাণের প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া আছে।
আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার ২৪০টি পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। নষ্ট হয়েছে ৪০০ পানের বরজ। এতে ৩৯ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও শ্যামনগর সংবাদদাতা জানান, জলোচ্ছ্বাসে শ্যামনগরে চার হাজার ৭৬৫টি বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৬৫০ হেক্টর জমির চিংড়ি ঘের ও ৯০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আটটি পয়েন্টে ২০৫ মিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার চারটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে তিন হাজার ৬০০ হেক্টের চিংড়ি ও মৎস্য ঘের তলিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের বরাত দিয়ে পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় আবাদকৃত ১৬৭ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, সাত হাজার ৩১৮ হেক্টর আবাদি জমি, এক হাজার ৩৩৫ হেক্টর সবজি খেত, ১৪১ হেক্টর জমির পানের বরজসহ ২১২ হেক্টর বিভিন্ন রবিশস্যের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমএ বারী জানান, মঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানী, ভাণ্ডারিয়া, কাউখালী, নাজিরপুর ও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ায় ৫৯৬ হেক্টর জলাশয়ের ২১৫৭টি ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে, প্রায় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বন বিভাগ সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আক্রান্ত জেলাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চাওয়া হয়েছে। হিসাব চূড়ান্ত করতে আরও সপ্তাহ খানেক লাগবে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস গত বুধবার সকালে ভারতের ওডিশা রাজ্যে আঘাত হানার পর ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর ক্ষতি করেছে। গত বছর করোনাকালে আম্পানের ধাক্কা সামলানোর আগেই আবার জলোচ্ছ্বাসের আঘাত মোকাবিলা করতে হচ্ছে উপকূলের মানুষকে। প্রাথমিকভাবে সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সব হিসাব উপস্থাপন করার পর চূড়ান্ত তথ্য জানানো হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা তথ্য পেয়েছি অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার মানুষের সহায়তায় সাড়ে ১৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মৎস্যজীবী যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হবে। যাদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সরবরাহ করা হবে।
সুন্দরবনে বড় ক্ষতির আশঙ্কা :সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে চারটি কমিটি করা হয়েছে। সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের অন্তর্গত শরণখোলা, চাঁদপাই রেঞ্জ, খুলনা জেলার নলিয়ান ও সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে চারটি মৃত ও দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালাসহ পূর্ব বন বিভাগের ১৯টি জেটি, ছয়টি জলযান, দুটি রেস্ট হাউস, একটি ব্যারাক, একটি গোলঘর, ১০টি অফিস ও স্টেশনে টিনের চালা উড়ে গেছে, ভেঙে গেছে দুটি টাওয়ার, ২৪টি পাটাতনের রাস্তা। ৯টি মিষ্টিপানির পুকুরে নোনাপানি ঢুকে পড়েছে। বনের মধ্যে আর কোনো বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের প্রভাবে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এর প্রভাবে বনের অভ্যন্তরে লবণ পানি প্রবেশ করছে। প্রজনন কেন্দ্রে কুমিরের শেডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে এত পানি আমি আগে কখনও দেখিনি। এমন অবস্থায় সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে প্রাথমিকভাবে ৬০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্নিষ্ট সব অফিসের আওতাধীন বনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বনরক্ষীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সমকালের বাগেরহাট, শরণখোলা ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, গত বুধবার দুপুরে দুবলা থেকে একটি, কচিখালী থেকে একটি, শরণখোলা উপজেলা সদরের বলেশ্বর নদীর রাজেস্বর এলাকা থেকে একটি ও গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চাল রায়েন্দা এলাকা থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়। মৃত হরিণগুলো মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মঠবাড়িয়ার বেতমোড় ও গোলবুনিয়ার লোকালয়ে চলে যাওয়া দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
কৃষি ও মাছের ক্ষতি : জলোচ্ছ্বাসে ফসল, মাছের ঘের ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। বিশেষ করে সবজির ক্ষতি উদ্বেগজনক। অন্যদিকে দেশের ৯টি উপকূলীয় জেলার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায়। জলোচ্ছ্বাসের কারণে সেখানকার মাছের ঘের থেকে প্রচুর মাছ ভেসে গেছে। বিভিন্ন স্থানে ভেসে গেছে গবাদি পশু। কৃষি ও মাছের ক্ষতির হিসাবও এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আমরা মাঠে নির্দেশনা দিয়েছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা এটার মূল্যায়ন করছেন। কাল-পরশুর মধ্যে মোট ক্ষতির হিসাব পেয়ে যাব।
তিনি বলেন, ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। কিছু শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক বা বড় কোনো ফসলের ক্ষতি হয়নি বলে আশা করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, জেলার রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া, গলাচিপা, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, দুমকী, বাউফল ও সদর উপজেলার সাত হাজার ৮৫টি ঘের ও পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, চিংড়ি ও পোনা জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাঙ্গাবালী উপজেলায়। এ উপজেলার ৯০ ভাগ ঘের ও পুকুরের সব মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। এতে জেলায় মোট ক্ষতি হয়েছে ৫৫ কোটি চার লাখ ২৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৫৫ লাখ ২৫ হাজার, চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, পোনার ক্ষতি হয়েছে দুই কোটি দুই হাজার টাকা এবং বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে তিন কোটি ৫১ লাখ টাকার।
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি জানান, রামগতির চরাঞ্চলে মেঘনা নদীর জোয়ারের পানিতে দুই শতাধিক গবাদি পশু ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন জানিয়েছেন, গবাদি পশুগুলো উদ্ধারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। গবাদি পশু আশ্রয়ের জন্য চরে মাটির কিল্লা নির্মাণের প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া আছে।
আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার ২৪০টি পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। নষ্ট হয়েছে ৪০০ পানের বরজ। এতে ৩৯ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও শ্যামনগর সংবাদদাতা জানান, জলোচ্ছ্বাসে শ্যামনগরে চার হাজার ৭৬৫টি বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৬৫০ হেক্টর জমির চিংড়ি ঘের ও ৯০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আটটি পয়েন্টে ২০৫ মিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার চারটি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে তিন হাজার ৬০০ হেক্টের চিংড়ি ও মৎস্য ঘের তলিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের বরাত দিয়ে পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় আবাদকৃত ১৬৭ হেক্টর আউশ ধানের বীজতলা, সাত হাজার ৩১৮ হেক্টর আবাদি জমি, এক হাজার ৩৩৫ হেক্টর সবজি খেত, ১৪১ হেক্টর জমির পানের বরজসহ ২১২ হেক্টর বিভিন্ন রবিশস্যের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমএ বারী জানান, মঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানী, ভাণ্ডারিয়া, কাউখালী, নাজিরপুর ও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ায় ৫৯৬ হেক্টর জলাশয়ের ২১৫৭টি ঘের ও পুকুর তলিয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে, প্রায় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
মন্তব্য করুন