- বাংলাদেশ
- নাজুক বাঁধে বিপন্ন জীবন
নাজুক বাঁধে বিপন্ন জীবন
দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে উপকূলের ছয় জেলার বেড়িবাঁধগুলো

খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে বৃহস্পতিবার এভাবেই পানি ঢোকে লোকালয়ে সমকাল

খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে বৃহস্পতিবার এভাবেই পানি ঢোকে লোকালয়ে সমকাল
চৌদ্দ বছর আগে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন সিডর যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলের মানুষ। এরপর একে একে আঘাত হানে বুলবুল, আইলা, মহাসেন, ফণী, আম্পানের মতো সুপার সাইক্লোন। সর্বশেষ গত বুধবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের মৃদু আঁচ লাগলেও এ থেকে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ি, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি। গত দেড় দশকে দুর্যোগের ভয়াবহতা বাড়লেও সেই ষাটের দশকে নির্মিত জরাজীর্ণ এসব বেড়িবাঁধ জানমাল রক্ষায় কোনো কাজেই আসছে না। উপকূলের দরিদ্র মানুষের জীবন আরও বিপন্ন করে তুলছে নাজুক বাঁধগুলো।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায় অন্তত চার হাজার ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয় সেই ষাটের দশকে। এসব বাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বাঁধের অর্ধেকও এখন আর অবশিষ্ট নেই। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ, লঘুচাপ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে গ্রামে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না বাঁধগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় নদীগুলোতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। ফলে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকেছে। পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, ইয়াসের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাউবো বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার বলেন, বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার ১২টি পয়েন্টে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ওই তিন জেলার শত শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধের পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাউবো কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী সমকালকে বলেন, বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কম এবং এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। বাঁধগুলো লবণাক্ত মাটি দিয়ে তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বাঁধের মাটির গাঁথুনি (বন্ডিং) দুর্বল করে ফেলে। এ ছাড়া বাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি তোলার কারণেও এগুলো দুর্বল হয়ে গেছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশ্রাফুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের চরিত্র বা ধরন বদলে গেছে। গত এক দশকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা এবং দূর্যোগের ভয়াবহতা বহুগুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা। বাঁধগুলো এখন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সামলাতে পারছে না। অর্ধশত বছরের পুরোনো বাঁধগুলো খুবই নাজুক ও দুর্বল। তিনি বলেন, দুর্যোগের গতি-প্রকৃতি এবং ভয়াবহতা অনুধাবন করে উপকূলে জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী বাঁধগুলো নির্মাণ করতে হবে টেকসই মহাপরিকল্পনা নিয়ে। কিন্তু তেমন আধুনিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না।
পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক দপ্তর সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৬৯ কিলোমিটার টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। ৮২টি পোল্ডারের আওতায় ওই তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে সিডরে ১৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতি হয়েছিল। এরপর আইলা ও মহাসেনের আঘাতে ৫২৭টি বাঁধের মধ্যে ৬৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ও ৫ দশমিক ১৯ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আম্পানে ১৬১ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার বাঁধের ১০ শতাংশ মোটামুটি ভালো। বাকি ৯০ শতাংশই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ৯০ শতাংশ বাঁধের মধ্যে ১০ শতাংশ আছে শুধু নামমাত্র। তিনি বলেন, এ অবস্থায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য সাতটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পর্যায়ক্রমে আরও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
বরিশাল পাউবো জানায়, বিভাগের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সংস্কার কাজ শুরু হয়। পরে সেটি বন্ধ হয়ে যায় তহবিল সংকটের কারণে। আবার ২০১৪ সালে ওই কাজ শুরু হয়। এখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এক হাজার ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় বরগুনায় দুটি, পটুয়াখালীতে তিনটি এবং পিরোজপুর জেলায় একটিসহ ছয়টি পোল্ডারের বাঁধ উঁচুকরণের কাজ চলছে।
বরগুনার পাথরঘাটার উন্নয়ন সংগঠন সংকল্প ট্রাস্টের পরিচালক মির্জা সাইদুর রহমান খালেদ বলেন, যখনই দেশে বড় কোনো ঝড়ঝঞ্ঝা হয়, তখনই বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। ঝড় থেমে গেলে আলোচনাও থেমে যায়। জেলার মাঝেরচরের বাসিন্দা গোলাম কবির বলেন, 'মোরা পেত্তেক বচ্ছর (প্রতিবছর) পানিতে ভাসি, কিন্তু মোগো রক্ষার লইগ্যা কেউ আউগাইয়া আয় না। ওয়াবদার লোকজন মাপঝোপ কইর্যা নেয়, কিন্তু কামের কাম কিছুই অয় না, মোরা বর্ষাকাল আইলেই দিনে দুইবার জোয়ারে ডুবি। বইন্যা আইলে আর বাঁচন যায় না। সিডরে ৭৭ জন মানু মরছে মাঝেরচরে।'
খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের হাফিজুর রহমান, আবুল বাশার ও ইয়াকুব শেখ বলেন, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এর ফলে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখনোই এগুলো ভালোভাবে সংস্কার করা হয়নি। কাজ হয়েছে দায়সারাভাবে। ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধ সংস্কারের টাকা লুটপাট করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরগুনা জেলা শাখার সদস্য সচিব মুশফিক আরিফ বলেন, ইয়াসের প্রভাবে যে পরিমাণ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তা সিডর, আইলা ও আম্পানে হয়নি। ইয়াস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, যে বাঁধ আছে তা দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে পারছে না।
বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বুধবার রাতে সমকালকে বলেন, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণে সরকার যে বরাদ্দ দেয় তা যথাযথভাবে ব্যয় হয় না। তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ কারণে উপকূলের মানুষের দুঃখ-দূর্দশাও ঘোচে না।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, ৬০ বছর আগে তৈরি বেড়িবাঁধ দিয়ে উপকূলীয় এলাকা রক্ষা করা এখন আর সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি নতুন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে দাবি উত্থাপন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ড্রেজিং করে উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোর গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলায় অন্তত চার হাজার ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয় সেই ষাটের দশকে। এসব বাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বাঁধের অর্ধেকও এখন আর অবশিষ্ট নেই। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ, লঘুচাপ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে গ্রামে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না বাঁধগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় নদীগুলোতে জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। ফলে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে লবণ পানি ঢুকেছে। পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, ইয়াসের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাউবো বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম সরকার বলেন, বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার ১২টি পয়েন্টে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ওই তিন জেলার শত শত গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধের পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পাউবো কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী সমকালকে বলেন, বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কম এবং এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। বাঁধগুলো লবণাক্ত মাটি দিয়ে তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বাঁধের মাটির গাঁথুনি (বন্ডিং) দুর্বল করে ফেলে। এ ছাড়া বাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি তোলার কারণেও এগুলো দুর্বল হয়ে গেছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশ্রাফুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের চরিত্র বা ধরন বদলে গেছে। গত এক দশকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা এবং দূর্যোগের ভয়াবহতা বহুগুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা। বাঁধগুলো এখন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত সামলাতে পারছে না। অর্ধশত বছরের পুরোনো বাঁধগুলো খুবই নাজুক ও দুর্বল। তিনি বলেন, দুর্যোগের গতি-প্রকৃতি এবং ভয়াবহতা অনুধাবন করে উপকূলে জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী বাঁধগুলো নির্মাণ করতে হবে টেকসই মহাপরিকল্পনা নিয়ে। কিন্তু তেমন আধুনিক পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না।
পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক দপ্তর সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৬৯ কিলোমিটার টেকসই উন্নয়ন হয়েছে। ৮২টি পোল্ডারের আওতায় ওই তিন হাজার ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে সিডরে ১৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতি হয়েছিল। এরপর আইলা ও মহাসেনের আঘাতে ৫২৭টি বাঁধের মধ্যে ৬৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার সম্পূর্ণ ও ৫ দশমিক ১৯ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আম্পানে ১৬১ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
পাউবোর খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন জানান, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার এক হাজার ৬৫০ কিলোমিটার বাঁধের ১০ শতাংশ মোটামুটি ভালো। বাকি ৯০ শতাংশই জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই ৯০ শতাংশ বাঁধের মধ্যে ১০ শতাংশ আছে শুধু নামমাত্র। তিনি বলেন, এ অবস্থায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য সাতটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পর্যায়ক্রমে আরও প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
বরিশাল পাউবো জানায়, বিভাগের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সংস্কার কাজ শুরু হয়। পরে সেটি বন্ধ হয়ে যায় তহবিল সংকটের কারণে। আবার ২০১৪ সালে ওই কাজ শুরু হয়। এখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এক হাজার ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় বরগুনায় দুটি, পটুয়াখালীতে তিনটি এবং পিরোজপুর জেলায় একটিসহ ছয়টি পোল্ডারের বাঁধ উঁচুকরণের কাজ চলছে।
বরগুনার পাথরঘাটার উন্নয়ন সংগঠন সংকল্প ট্রাস্টের পরিচালক মির্জা সাইদুর রহমান খালেদ বলেন, যখনই দেশে বড় কোনো ঝড়ঝঞ্ঝা হয়, তখনই বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। ঝড় থেমে গেলে আলোচনাও থেমে যায়। জেলার মাঝেরচরের বাসিন্দা গোলাম কবির বলেন, 'মোরা পেত্তেক বচ্ছর (প্রতিবছর) পানিতে ভাসি, কিন্তু মোগো রক্ষার লইগ্যা কেউ আউগাইয়া আয় না। ওয়াবদার লোকজন মাপঝোপ কইর্যা নেয়, কিন্তু কামের কাম কিছুই অয় না, মোরা বর্ষাকাল আইলেই দিনে দুইবার জোয়ারে ডুবি। বইন্যা আইলে আর বাঁচন যায় না। সিডরে ৭৭ জন মানু মরছে মাঝেরচরে।'
খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের হাফিজুর রহমান, আবুল বাশার ও ইয়াকুব শেখ বলেন, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এ ছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এর ফলে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোংলার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখনোই এগুলো ভালোভাবে সংস্কার করা হয়নি। কাজ হয়েছে দায়সারাভাবে। ঠিকাদাররা বেড়িবাঁধ সংস্কারের টাকা লুটপাট করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরগুনা জেলা শাখার সদস্য সচিব মুশফিক আরিফ বলেন, ইয়াসের প্রভাবে যে পরিমাণ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তা সিডর, আইলা ও আম্পানে হয়নি। ইয়াস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, যে বাঁধ আছে তা দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে পারছে না।
বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বুধবার রাতে সমকালকে বলেন, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণে সরকার যে বরাদ্দ দেয় তা যথাযথভাবে ব্যয় হয় না। তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দূর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ কারণে উপকূলের মানুষের দুঃখ-দূর্দশাও ঘোচে না।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য শেখ মো. আকতারুজ্জামান বাবু বলেন, ৬০ বছর আগে তৈরি বেড়িবাঁধ দিয়ে উপকূলীয় এলাকা রক্ষা করা এখন আর সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি নতুন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে দাবি উত্থাপন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ড্রেজিং করে উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোর গভীরতা বাড়ানো প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন