‘জাহালমকাণ্ড’ এড়াতে পুলিশ প্রবিধানে সংশোধনের প্রস্তাব
ছবি-সমকাল
ইন্দ্রজিৎ সরকার
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:৩৮ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১১:৩৮
‘নামে নামে যমে টানে’– প্রচলিত এ বাক্যের মতো নাম বিভ্রাটের কারণে ভুল আসামি গ্রেপ্তার ও কারাবাসের ঘটনা মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের মামলায় নিরীহ জাহালমের কারাবাসের ঘটনা তো ব্যাপকভাবে আলোচিত। এ ছাড়া রাজধানীর পল্লবীর বেনারসিপল্লির মো. আরমান, কিশোরগঞ্জের ইটনার জামসু মিয়া, টাঙ্গাইলের সখীপুরের বাবুল হোসেন নয়ন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মো. লিটনের গ্রেপ্তার ও কারাবাসের মতো ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এড়াতে পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) ৩৮৯ বিধি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সম্প্রতি পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠানো হয়েছে এ-সংক্রান্ত চিঠি। সেখানে মূলত ওই বিধিতে বর্ণিত অনুসন্ধান স্লিপে (বিপি ফরম নম্বর-৭৭) কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে।
পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নাম বিভ্রাট এড়াতে অনুসন্ধান স্লিপে কয়েকটি পয়েন্ট যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আসামির ছবি, মায়ের নাম, আসামির ডাকনামসহ একাধিক নাম থাকলে তা উল্লেখ করার সুপারিশ করেছে পিবিআই।
পুলিশ সদরদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপরাধ ব্যবস্থাপনা) জয়দেব কুমার ভদ্র বলেন, পিবিআই থেকে পাঠানো প্রস্তাবটি আমরা পেয়েছি। এখন এটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পলিসি গ্রুপে অনুমোদন হলে বিষয়টি পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে উপস্থাপন করা হবে। তিনি সম্মতি দিলে অনুসন্ধান স্লিপে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে।
পিবিআই সূত্র জানায়, বিনা অপরাধে পল্লবীর বেনারসিপল্লির কারিগর মো. আরমানের কারাবাসের ঘটনায় ২০১৯ সালের এপ্রিলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। আলোচিত এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর মা ভানু বেগম হাইকোর্টে রিট (৭২৯৭/২০১৯) করেন। সেখানে তিনি ঘটনার প্রতিকার চাওয়ার পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান। আদালত এ ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং পিবিআইপ্রধানকে একটি কমিটি করে বিষয়টি অনুসন্ধান করতে বলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী তিন সদস্যের কমিটি দায়দায়িত্ব নিরূপণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কিছু সুপারিশ করে।
সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো আসামির পরিচয় নিশ্চিত হতে প্রচলিত নিয়ম ও বিধি অনুযায়ী যে অনুসন্ধান স্লিপ (বিপি ফরম নম্বর-৭৭) ব্যবহার হয়, তাতে তথ্যের অপর্যাপ্ততা ও অসম্পূর্ণতা রয়েছে। এ কারণে সঠিক ব্যক্তি শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমান অনুসন্ধান স্লিপকে ভিত্তি ধরে একটি নতুন অনুসন্ধান স্লিপের প্রস্তাবনা হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হয়। আদালত ২০১৯ সালের ১৫ জুন রায়ে বিষয়টি রেকর্ডভুক্ত করার আদেশ দেন।
নতুন অনুসন্ধান স্লিপের প্রস্তাব
পিবিআইপ্রধান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গত ৬ নভেম্বর পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও সঠিক অপরাধীকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে পিবিআই প্রস্তাবিত অধিক তথ্য সংবলিত অনুসন্ধান স্লিপ যাচাই-বাছাই করে সংশোধনের ব্যবস্থাসহ পিআরবির সংশ্লিষ্ট বিধি সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো হলো।’
বিদ্যমান অনুসন্ধান স্লিপে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান করা ব্যক্তিদের নাম, বংশ ইত্যাদিসহ বিশদ বিবরণ এখানে উল্লেখ করতে হবে। প্রস্তাবিত অনুসন্ধান স্লিপে বলা হয়েছে, অনুসন্ধান করা ব্যক্তিদের নাম (ডাকনামসহ একাধিক নাম থাকলে সেগুলো), বাবা-মায়ের নাম ও বংশ বিশদভাবে উল্লেখ করতে হবে। এর সঙ্গে সেই ব্যক্তির ছবি পাওয়া গেলে তা যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। আর অনুসন্ধানের ফলাফল কলামে যুক্ত করতে বলা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
চার সুপারিশ
এর আগে ২০২১ সালে হাইকোর্টের আদেশে নাম বিভ্রাটে ভুল ব্যক্তির কারাবাসের ঘটনা অনুসন্ধানের পর চারটি সুপারিশ করেছিল পিবিআই। এর মধ্যে রয়েছে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তারের পর ধারণ করতে হবে তার ছবি। অনুসন্ধান স্লিপের তদন্ত শেষে এর সঙ্গে আসামির এনআইডি/পাসপোর্টের কপি/ড্রাইভিং লাইসেন্স/জন্মনিবন্ধনের কপি সংযুক্ত করতে হবে।
পিবিআই সূত্র বলছে, পুলিশ প্রবিধানের (পিআরবি) ৩৮৯ বিধিতে অনুসন্ধান স্লিপের উল্লেখ থাকলেও সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বিস্তারিত বলা নেই। তাই বিধি সংশোধন না করেও অনুসন্ধান স্লিপ হিসেবে ব্যবহৃত ফরমে পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
সদিচ্ছার অভাব থাকলে লাভ হবে না
সমাজ ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, অনুসন্ধান স্লিপে ছবিসহ আসামির বিস্তারিত তথ্য যুক্ত করার উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে দায়িত্ব পালনে পুলিশের সদিচ্ছার অভাব থাকলে এতে বিশেষ লাভ হবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যদি সঠিকভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর আমরা যাকে সামান্য ‘ভুল’ হিসেবে উল্লেখ করছি, এটি একজন নিরপরাধ মানুষের জীবনে কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনে তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের অনুধাবন করা কঠিন। ভুল আসামি গ্রেপ্তার ও কারাবাসের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। তাই পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে।