ওসি ইউএনওদের বদলির নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের
ছবি-সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:৫৭ | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৬:১৭
বর্তমান কর্মস্থলে এক বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন, এমন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানায় ছয় মাসের বেশি দায়িত্ব পালন করছেন, এমন ওসিদের বদলি করাতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বদলির প্রস্তাব আগামী ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসিতে পাঠাতে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ইসির উপসচিব (চলতি দায়িত্ব) মিজানুর রহমানের সই করা এ সংক্রান্ত দুটি চিঠি দুই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
ইউএনও বদলির বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে পাঠানো ইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সব ইউএনওকে পর্যায়ক্রমে বদলির সিদ্ধান্ত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যেসব ইউএনওর বর্তমান কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনের মেয়াদকাল এক বছরের বেশি হয়ে গেছে, তাদের অন্য জেলায় বদলির প্রস্তাব ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসিতে পাঠানো প্রয়োজন।
নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইউএনওরা। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। এখন ইউএনওদের রদবদল করা হলে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
এর আগে ওসি বদল বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবকে পাঠানো ইসির চিঠিতে বলা হয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সব থানার ওসির পর্যায়ক্রমে বদলি করার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যেসব থানার ওসির বর্তমান কর্মস্থলে ছয় মাসের বেশি সময় পার হয়েছে, তাদের অন্য জায়গায় বদলির প্রস্তাব ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো প্রয়োজন।
এতদিন ধরে ইসি বলে আসছিল, পুলিশ ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে বড় রদবদল আনা হবে না। গত ২২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মাঠ প্রশাসনে রদবদল করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা হলে তার দায় কে নেবে?
প্রশাসনে রদবদল করা হবে কিনা– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গত রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল পাল্টা প্রশ্ন রেখেছিলেন, প্রশাসনে রদবদল কে কখন করেছিল? তিনি বলেন, তারা নির্বাচনের স্বার্থে যেটা ভালো মনে করবেন, সেটাই করবেন। তবে এখতিয়ারের বাইরে যাবেন না। এখতিয়ারের মধ্যে যা আছে, তা করবেন।
সিইসির এ বক্তব্যের চার দিনের মাথায় পুলিশের মাঠ পর্যায়ে বড় রদবদল আনার সিদ্ধান্ত নিল ইসি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং পুলিশ মহাপরিদর্শকের সঙ্গে ইসি বৈঠক করে। ওই দিন বিকেলে জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গেও বৈঠক হয়। এর পর পুলিশ ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে রদবদলের চিঠি দেওয়া হয়। পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়েও রদবদল করার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ডিসিদেরও রদবদল হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। আজকালের মধ্যে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।
আটটি মহানগরসহ দেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৩৬। সাধারণত নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিদর্শকরাই ঘুরেফিরে থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেন। তবে ছয় মাসের বেশি কতজন ওসি থানায় দায়িত্ব পালন করছেন, সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ সদরদপ্তর।
বদলির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এভাবে সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং ওসিদের বদলি করেছিল। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ছিল, এর মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি হয়। কারণ, কোনো স্থানে দীর্ঘদিন থাকার ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সখ্য হয়ে যায়। এর ফলে তারা হয়তো নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তাই তাদের বদলি করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই ধারণা থেকেই হয়তো বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা যা ভালো মনে করেছেন, সেটিই করেছেন।
নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে সংগঠনটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, ‘ইসির নির্দেশনার আলোকে যাকে যেখানে দেওয়া হবে, তিনি ওই জায়গায় কাজ করতে বাধ্য। এর আগেও জাতীয় নির্বাচনের আগে ওসিদের রদবদল করা হয়েছে। এটি কোনো নতুন বিষয় নয়।’ ওসি বদলির বিষয়ে ভিন্ন মন্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক থানার ওসি বলেন, ‘কোনো অভিযোগ ছাড়া এভাবে বদলি করলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। কাউকে বদলি করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে।’
পুলিশ সদরদপ্তর ও রেঞ্জের একাধিক ডিআইজির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসির নির্দেশনার আলোকে কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় ওসিদের রদবদল করা হবে, সেটা আজকালের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। এক ইউনিট থেকে অন্য ইউনিটে বদল হতে পারে। আবার এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ওসি দায়িত্ব পেতে পারেন। বর্তমান নীতিমালায় সাধারণত ৫৪ বছর বয়সের বেশি কাউকে ওসি পদে বসানো হয় না। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক ধরনের ফিটলিস্টও তৈরি করা আছে। কে কার পর ওসির পদে আসতে পারেন, ওই ফিটলিস্টে তা উল্লেখ করা থাকে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদরদপ্তর নতুন ওসিদের তালিকা ঠিক করতে পারে। এমনকি রেঞ্জের কাছে নাম চাইতে পারে। পুরো প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ইসির পরামর্শ নিতে পারে তারা।
ইউএনও এবং ওসিদের বদলির বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান সমকালকে বলেন, এটি একটি অদ্ভুত আদেশ। সরকার এটি গ্রাহ্য করবে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডিসি ও সচিব পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল হয়েছিল। কিন্তু একদিনে এমন সব ইউএনও এবং থানার ওসির বদলির আদেশ নজিরবিহীন।
তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের ‘ডামি’ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। এটি নিজেরা নিজেরা নির্বাচন। এখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেই। এই রদবদলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। ইউএনও এবং ওসিদের ট্রান্সফার ভাতা সব যোগ করলে বিপুল অঙ্ক দাঁড়ায়। বর্তমান তপশিলে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এই রদবদল তাতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আনবে না।