- বাংলাদেশ
- বাঁধভাঙা মানুষের কান্না...
বাঁধভাঙা মানুষের কান্না...

ছবি:শেখ হারুন অর রশিদ
ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস'-এর প্রবল জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় খুলনার কয়রা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রান্তিক এ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় ১৮শ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে, ভেঙেছে ৪৬ হাজারের বেশি বসতবাড়ি। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ২৪০ প্রতিবন্ধীসহ দুই লাখ ১৩ হাজার ৪২৮ জন। ভেসে গেছে গবাদি পশু-পাখিসহ পুকুর ও ঘেরের মাছ, এলাকার রাস্তাঘাট। এ দৃশ্য শুধু এবারের নয়। আইলা-পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতি বছরই কয়রার মানুষকে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সম্প্র্রতি কয়রা ঘুরে এসে লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম আবেদ ও আব্দুল কাইয়ুম
প্রতি বছর মে-জুন মাস এলেই বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শঙ্কায় কাটে দিনরাত্রি- এই বুঝি সাগরে নিম্নচাপ শুরু হলো, এলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, চিংড়িঘের, খাল-বিল, পুকুর। কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেসে যায় খুলনার কয়রাবাসী মানুষের আজন্ম লালিত সাজানো সংসার। ঘরের দুয়ারে টানা দু'বছর জোয়ার-ভাটা ঠেলে জীবন চলেছে কোনো রকম। তারপর এক দিন পানি নেমেছে। বসতবাড়ি জেগেছে একটু একটু করে। কিন্তু বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়া, এ অঞ্চলের মানুষের ললাট লিখন হয়ে রইল ফি বছরের জন্য।
বুক পেতে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা
'২৬ মে দুপুরের দিকে ইয়াস যখন ভারত উপকূল অতিক্রম করে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছিল, কয়রাবাসী তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে- এ যাত্রায় বুঝি রক্ষা পাওয়া গেল। ভুল ভাঙল দুপুরের কিছু পরে; যখন দশহালিয়ার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমাদের গ্রাম তলিয়ে যেতে সময় লাগল মাত্র আধা ঘণ্টা।' বলছিলেন কয়রার শিমলার আইট গ্রামের অনার্স পড়ূয়া শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম। সেই দিনের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত দশহালিয়া গ্রামের রায়হান বলেন, 'দেখতে দেখতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে গেল। আমরা বাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে বুক পেতে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। চোখের সামনে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেল। মানুষ তাদের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সামলাবে নাকি ঘরের আসবাবপত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেবে। নারী-শিশু-বৃদ্ধদের নিরাপদে সরিয়ে নিতেই এদিকে ঘরবাড়ি তলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।'
বাস্তুচ্যুত মানুষ
শিমলার আইট গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, ইয়াসের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সবকিছু। দু'চোখ যেদিকে যায় শুধুই নোনাপানি। বাঁধভাঙার ঘণ্টা দুই পর শুরু হয় নতুন বিপদ। এ অঞ্চলের অধিকাংশ ঘর মাটির দেয়ালের। সেগুলো ধসে পড়তে লাগল একে একে। জোয়ারের পানিতে টিউবওয়েল ডুবে সুপেয় পানির আধার বন্ধ হলো। ফলে ভাঙাচোরা ঘরবাড়িতেও বসবাসের আর কোনো উপায় রইল না। এক দিন বাদে ঘের, পুকুর, খালের মাছ সব মরে পচে যেখানে সেখানে ভেসে বেড়াতে লাগল। উৎকট দুর্গন্ধে নিজেদের ঘরবাড়ি যেন ভাগাড় হয়ে গেল।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের দুই সপ্তাহ পর আমরা যখন নৌকায় করে মহারাজপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে যাচ্ছিলাম, তখনও ক্ষতগুলো স্পষ্ট। পৌঁছেনি কোনো সহযোগিতা। ভেঙে যাওয়া বাঁধ সংস্কারের কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ল না। এলাকার মানুষ নিজেদের রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁশ ও কাদা দিয়ে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত করলেও জোয়ারের সময় সেটিও কখনও কখনও উপচে উঠছে। দশহালিয়া গ্রামের সত্তর-ঊর্ধ্ব আবদুস সবুর মোড়ল বলেন, 'আমাদের এখন আর ঘূর্ণিঝড়ের অপেক্ষা করতে হয় না। সাধারণ জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা একটু বেড়ে গেলেই সর্বনাশ। নোনাপানিতে সব ডুবিয়ে নিয়ে চলে যায়। আর প্রতি বছর ভাঙন তো লেগেই আছে। নিজের পাড়ার দিকে নির্দেশ করে বলেন, 'আগে এখানে আমরা পনেরো ঘর মানুষ ছিলাম। এখন আছি মাত্র চার ঘর। যে যেদিকে পারে চলে যাচ্ছে।'
কেন ভাঙছে বাঁধ
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাইকগাছা এলে জনগণের দুঃখ লাঘবের জন্য কয়রায় কপোতাক্ষের পাড়ে বেড়িবাঁধ তৈরির নির্দেশ দেন। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড সেই বাঁধ নির্মাণ করে। এরপর দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। কয়রায় ১০৩ কিলোমিটারের এই বাঁধের ওপর দিয়ে গেছে নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আইলার আঘাতে বাঁধটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানালেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী হাসান মেহেদী। কথা হয় মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাঁধটি সার্বিকভাবে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কোথাও ব্লক ফেলে, কোথাও বস্তা ফেলে ঠেকা দেওয়া হয় মাত্র। ফলে প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও বাঁধটি ভাঙছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার মানুষ।
এলাকাবাসী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ উঠে আসে। প্রথমত, যেহেতু মাটির বাঁধ তাই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। কিন্তু কোথাও ভাঙার আগে সেটা হয় না। এ ধরনের বাঁধের ওপরের দিকে ১৪ ফুট প্রস্থ থাকার কথা থাকলেও আট ফুটের বেশি কোথাও নেই। একই সঙ্গে উচ্চতাও কমে গেছে। অন্যদিকে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এখন জোয়ারের উচ্চতা আগের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, লবণাক্ততার জন্য বাঁধের মাটির আঠালো ভাব নষ্ট হয়ে আগের চেয়ে অনেক ভঙ্গুর হয়ে গেছে। ফলে একটুতেই বাঁধ ভেঙে যায়। তৃতীয়ত, পানির উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে ঘের মালিকরা নিয়মিত বাঁধ কেটে ঘেরে লবণপানি ঢোকায় এবং কেউ কিছু বলে না। চতুর্থত, নিয়মিত মেরামতের জন্য স্থানীয়ভাবে তহবিল প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখানে কিছু করতে হলে খুলনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় অফিসে যেতে হয়। সেখানে তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা। ততদিনে বাঁধে নতুন করে আবার ভাঙন তৈরি হয়।
সংস্কার নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী
প্রতি বছর দেখা যায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে এলাকার মানুষ জানমাল রক্ষায় নিজ উদ্যোগে তা মেরামত করে। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড এসে কিছু বালুর বস্তা, ব্লক বা টিউব ফেলছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। দশহালিয়া গ্রামের ক্ষুব্ধ নাজমুল হাসান বলেন, আমাদের নিয়ে একটা ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। প্রতি বছর বাঁধ ভাঙবে। আমরা মেরামত করব। তারপর ঠিকাদার এসে সংস্কারের নামে কয়েকটা বস্তা ফেলে, লিপস্টিকের মতো আস্তরণ দিয়ে বিল তুলে নিয়ে যাবে। পরের বছর আবার ভাঙবে। আমরা এই বাঁধ চাই না। বাঁধ ভেঙে গেলে ত্রাণ নিয়ে আসবেন, আমরা সেই ত্রাণ চাই না। আমরা টেকসই বাঁধ চাই। যাতে করে জানমাল নিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারব।
মন্তব্য করুন