
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। এরপর দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও আলোচিত এ মামলার তদন্তে কার্যকর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে খুন হন মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। আট বছরের বেশি সময় ধরে এই মামলার তদন্তও ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসের ওলিপুরের পাওয়ার হাউস এলাকায় ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয় স্থানীয় ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর লাশ। সারাদেশে আলোড়ন তোলে তনু হত্যা। কিন্তু পাঁচ বছর পার হলেও এ মামলার তদন্তে আশার আলো জ্বলেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে বিচারপ্রার্থী স্বজনদের অপেক্ষার প্রহর শুধুই দীর্ঘ হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, খুনি শনাক্তে আর কত অপেক্ষা করতে হবে। তবে চট্টগ্রামে মাহমুদা খানম মিতু হত্যার পাঁচ বছর পর তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার গ্রেপ্তার হওয়ায় আশার আলো দেখছেন তদন্তাধীন এসব হত্যা মামলার বিচারপ্রার্থী স্বজনরা। মিতু হত্যা মামলায় বাবুলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে অবস্থান করছেন। তার এ পরিণতিতে তদন্ত সমাপ্তির অপেক্ষায় থাকা অন্য মামলায় সংশ্নিষ্টরাও নড়েচড়ে বসেছেন।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, 'দৃঢ়ভাবে এখনও বিশ্বাস করি, একদিন না একদিন ছেলে হত্যার বিচার পাব। খুনিদের চেহারা উন্মোচিত হবে। আইনের কাঠগড়ায় অপরাধীদের দাঁড়াতেই হবে। তবে যত তাড়াতাড়ি বিচার পাব, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ততই মঙ্গল।'
তনুর ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল জানান, চট্টগ্রামে মিতু হত্যার বহু বছর পর প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারাও আশা করছেন, তার বোনের হত্যাকারীরাও শনাক্ত হবে। জড়িতদের বিচার হবে। কারা, কেন তার বোনকে খুন করেছে, তা তারা জানতে পারবেন।
দেশে চাঞ্চল্যকর এ তিন হত্যা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের কার্যক্রম চালালেও রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি এখনও। সাগর-রুনি ও ত্বকী হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে র্যাব। তনু হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সাগর-রুনিকে। বেঁচে যায় তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পার হলেও এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। এ পর্যন্ত ৮০ বার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার ধার্য তারিখ পার হয়েছে। শিগগিরই অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে- এমন সম্ভাবনাও নেই বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র।
রাজাবাজারের বাসা থেকে সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধারের পর শেরেবাংলা নগর থানায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। প্রথমে এ মামলা তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। চার দিনের মাথায় সেটি হস্তান্তর করা হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় উচ্চ আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র্যাবে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
সাগর-রুনির মামলার তদন্তের নানা পর্যায়ে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এমন একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে এই ঘটনার অনেক আলামত সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। হত্যার পরপরই শত শত উৎসুক জনতা ও সাংবাদিক সাগর-রুনির বাসায় প্রবেশ করে। এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর এখন পুলিশ ক্রাইম সিন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দিকে মনোযোগী হচ্ছে।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গে নিহত সাংবাদিক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির জানান, তার সন্তান ও পুত্রবধূ খুন হয়েছে। তিনি সন্তানহারা হয়েছেন। সবাই এর নির্মমতা ভুলে গেলেও তিনি তা পারবেন না। যতদিন বেঁচে আছেন, হত্যার বিচার পাওয়ার আশাতেই থাকবেন। কেন তার ছেলে খুন হলো, তা তিনি জানতে চান। যদিও তিনি জানেন না, তা সম্ভব হবে কি-না।
মেহেরুন রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে রাগে-ক্ষোভে কোনো মন্তব্যই করেননি। শুধু বলেছেন, এ নিয়ে কথা বলে আর কী হবে!
সাগর-রুনি ও ত্বকী হত্যার মামলার তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, 'সঠিকভাবে তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তে যা যা করা দরকার র্যাব তা করছে। সাগর-রুনির বেশ কিছু আলামতের ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এখনও প্রতিবেদন আসেনি। প্রতিবেদন পেলে তদন্তে ভালো অগ্রগতি আসত। ত্বকীর মামলারও তদন্ত এগুচ্ছে। এটা নিশ্চিত করছি, দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন র্যাব দেবে না।'
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরে নিজেদের বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দু'দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নারায়ণগঞ্জসহ দেশব্যাপী এ হত্যাকা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা দেয়। এ মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ত্বকী হত্যার মামলাটি প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত শুরু করে র্যাব। ত্বকী হত্যার পর বিভিন্ন সময় ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি, সীমান্ত ও রিফাত নামে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাদের মধ্যে সুলতান শওকত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সুলতান শওকত ভ্রমর ছাড়া এ মামলায় গ্রেপ্তার সবাই বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। ভ্রমর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান। তবে চলতি বছরের মার্চে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
পাঁচ বছর পেরুলেও চাঞ্চল্যকর তনু হত্যাকাণ্ডের তদন্তেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে থানা পুলিশ থেকে ডিবি ও সিআইডি- তিনবার বদল হয়েছে তদন্ত সংস্থা আর চারবার বদল হয়েছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সর্বশেষ মামলার তদন্ত করছে পিবিআই। এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তনুর অন্তর্বাসে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া গেছে ডিএনএ পরীক্ষায়। এ থেকে ধারণা করা হয়, ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে এসব আলামত ব্যবহার করে এখনও সন্দেহাতীতভাবে কোনো আসামি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
তনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর পরিদর্শক মুজিবুর রহমান বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ছয় মাস ধরে তিনি তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কিছু ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা ল্যাবে পাঠিয়েছেন। এখনও প্রতিবেদন আসেনি। গুরুত্বের সঙ্গে এ মামলার তদন্ত চলছে।
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আসেন, আর নানা নতুন আশার কথা শোনানো হয় তাদের। এরপর সবাই সব ভুলে যায়। এরপরও মেয়ে হত্যার বিচারের আশায় আছেন তিনি।
মন্তব্য করুন