ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত সাহায্য চেয়ে '৩৩৩' নম্বরে ফোন এসেছিল দুই হাজার ২৪০টি। কিন্তু একজনও সাহায্য পাননি। একইভাবে ওই সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ফোন এসেছিল আরও বেশি; দুই হাজার ৯১২টি। সেখান থেকেও কাউকে সহায়তা করা হয়নি। একই চিত্র সাত মহানগরীতে; অনেকে ফোন করলেও কেউই ত্রাণ সহায়তা পাননি। এ ছাড়া আটটি জেলার উপজেলাগুলো থেকে একজন ব্যক্তিও খাদ্য সহায়তা পাননি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং এটুআই কর্মসূচি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ জুন পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তার জন্য ১৪ লাখ ৭ হাজার ১৩৭টি ফোনকল আসে '৩৩৩' নম্বরে। এর মধ্যে ৮ জুন এক দিনেই ফোন আসে ৬ হাজার ৫৫টি। এগুলো যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ১০ হাজার ৩১ জনকে প্রাথমিকভাবে সহায়তার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ জুন পর্যন্ত দেশের ৫৬টি জেলায় ৪৯ হাজার ৫২৮টি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর তিনটি সিটি করপোরেশনে সহায়তা পেয়েছে এক হাজার ৮৬১টি পরিবার। সারাদেশে মোট ৫১ হাজার ৩৮৯টি পরিবার খাদ্য সহায়তা পেয়েছে। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা এক লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৬। তবে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে আট জেলা এবং ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৯টি সিটির কোনো ওয়ার্ডেই ৩৩৩ নম্বরে ফোনের ভিত্তিতে কাউকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়নি।

সরকারি নির্দেশনার পরও গত দেড় মাসে জরুরি হটলাইন '৩৩৩' নম্বরে ফোন পেয়ে একটি পরিবারকেও খাদ্য সহায়তা করা হয়নি ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাঙামাটি, লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, খুলনা, ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ জেলায়। আর মহানগরীগুলো হলো- ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল।

দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এখান থেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন মাধ্যমে এ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতে কয়েক কোটি পরিবারের সুবিধা পাওয়ার কথা। গত ২৫ এপ্রিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছিলেন, 'আমরা ৩৩৩ নম্বরটি প্রচার করেছি। কেউ খাদ্যকষ্টে থাকলে ফোন করলে তাকে তালিকাভুক্ত করে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হবে।'

মাদারীপুর জেলায় গত ২৫ এপ্রিল থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ত্রাণসহায়তা চেয়ে ফোন এসেছে ৪৮৮টি। একজনও সাহায্য পাননি। সদর উপজেলার বাহেরচর এলাকার কাতলা গ্রামের শাহীন হাওলাদার বলেন, তিনি ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনা মহামারিতে তার চাকরি চলে গেছে। চর এলাকায় বাড়ি হওয়ায় তার কোনো উপার্জন নেই। পরিবার নিয়ে খাদ্যকষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, কিন্তু সহায়তা পাননি।

একই সময়ে জয়পুরহাট জেলায় ফোন এসেছিল ১৭৭টি। কেউই ত্রাণ পায়নি। কালাই পৌর এলাকার নাপিত গোপাল চন্দ্র শীল বলেন, জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ সহায়তার জন্য তার নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে গেছেন, কিন্তু সহায়তা দেননি।

জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) শরীফুল ইসলাম বলেন, ৩৩৩ নম্বরে কল করলে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে- এ বিষয়ে ইউএনওদের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। কেউ খাবার পাননি- এটা হতে পারে না।

একই দাবি করেন মাদারীপুরের ডিসি ড. রহিমা খাতুন। তবে কতজন সহায়তা পেয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ মুহূর্তে তা বলতে পারছি না।'

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফা জহুরা ত্রাণ দেওয়ার বদলে এক ব্যক্তিকে শাস্তি দিয়েছেন। আরিফা জহুরা বলেন, অনেকে ফোন করে যাচাই করেন, সহায়তা পাওয়া যায় কিনা। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ত্রাণের কোনো প্রয়োজন নেই।

এটুআইর তথ্যমতে, লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৩০৬ জন ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চেয়েছেন। কিন্তু ডিসি আনোয়ার হোছাইন আকন্দ দাবি করেন, '৩৩৩-এ কোনো ফোন পাইনি। ফোন পেলে খাদ্য সহায়তা দিতে পারব। জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার মজুদ আছে।'

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা সমকালকে বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। এজন্য তিনি সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সমকালকে বলেন, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যেভাবে কাজ হচ্ছে, সেভাবে সিটি করপোরেশনগুলোতে হয়নি। বেশিরভাগ সিটি করপোরেশন সন্তোষজনকভাবে কাজ করেনি। অথচ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটিতে তিন কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছোট সিটিগুলোতে ৩২ লাখ করে টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। গত বুধবার জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, '৩৩৩' নম্বরে ফোন করার ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার চেয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় বেশি আগ্রহী। তাই সরকারি খাবারের প্রচুর মজুদ থাকার পরও অনেক গরিব অসহায় মানুষ খাবার পাচ্ছেন না।

সরকারের এটুআই কর্মসূচির অধীনে চলা জরুরি হটলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রশাসনকে দিয়ে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। এই হটলাইন আগে থেকে চললেও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি মাঝে বন্ধ ছিল। গত ২৫ এপ্রিল থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সেবাটি আবার সচল করা হয়। ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে একাধিক সেবা পাওয়া যায়। এর মধ্যে করোনা মোকাবিলা, জরুরি খাদ্যসহ অন্যান্য সেবার জন্য প্রথমে '৩৩৩'-এ গিয়ে তার পর '৩' চাপতে হয়। তখন ফোন করলে প্রথমেই কিছু বিষয় জানতে চাওয়া হয়। যেমন, ফোন করা ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সরকারি ত্রাণ বা ভাতা, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) বা ১০ টাকা কেজি দরে চাল পেয়েছেন কিনা। তথ্য যাচাই-বাছাই করে ত্রাণ পাওয়ার মতো ব্যক্তিদের প্রাথমিক তালিকা নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হয়।