দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে ১১৯ জন মারা গেছেন। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এক দিনে এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়নি। এর আগে ১৯ এপ্রিল এক দিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় আগের সেই রেকর্ড ভেঙে গেল। এ নিয়ে করোনায় মোট ১৪ হাজার ১৭২ জন প্রাণ হারালেন। একই সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও পাঁচ হাজার ২৬৮ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শনাক্তের সংখ্যা আট লাখ ৮৮ হাজার ৪০৬ জনে পৌঁছাল। দেশে করোনার সংক্রমণ-মৃত্যু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জুনের শেষ সপ্তাহে এসে দেশে করোনায় মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আর সংক্রমণ চলতি বছরের এপ্রিলের 'পিকে'র প্রায় সমানে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, করোনার সংক্রমণ-মৃত্যু যে হারে বাড়ছে, তাতে মার্চ-এপ্রিলের চেয়েও পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

মৃত্যুর হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ১৮ মার্চ করোনায় দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। এর পর শনাক্ত-মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল প্রথম মৃত্যুর সংখ্যা শতকের ঘর ছাড়ায়। ওই দিন ১০১ জনের মৃত্যু হয়। একই মাসে আরও পাঁচবার দিনে একশর ওপরে করোনায় মৃত্যু হয়। ১৭ এপ্রিল ১০১ জন, ১৮ এপ্রিল ১০২ জন ও ১৯ এপ্রিল ১১২ জনের মৃত্যু হয়। ছয় দিনের মাথায় ২৫ এপ্রিল আবারও ১০১ জনের মৃত্যু হয়। তবে মাঝখানের ওই পাঁচ দিন মৃত্যুর সংখ্যা ৯০ জনের ওপরে ছিল। এরপর এক মাসের মাথায় ২৫ জুন মৃত্যুর সংখ্যা আবারও একশ ছাড়ায়। ওই দিন করোনায় ১০৮ জনের মৃত্যু হয়। গতকাল আগের সব রেকর্ড ভেঙে করোনা সংক্রমিত ১১৯ জনের মৃত্যু হলো।

মৃত্যুতে শীর্ষে, সংক্রমণে দ্বিতীয় খুলনা: করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু পরিস্থিতি বিশ্নেষণে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৬৪৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই ১ হাজার ৮১ জন। এরপর দ্বিতীয় স্থানে থাকা খুলনা বিভাগে ১ হাজার ২০২ জন, তৃতীয় স্থানে থাকা রাজশাহীতে ৯৬২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৮৯ জন, রংপুরে ৪৭৭ জন, ময়মনসিংহে ২৭১, বরিশালে ১৫০ এবং সিলেটে ৯৯ জন শনাক্ত হয়েছে। আর মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে খুলনা বিভাগ। গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে ঢাকায় ২৪ জন, রাজশাহীতে ২২, চট্টগ্রামে ২২, রংপুরে ৯, সিলেটে ৫, ময়মনসিংহে ৩ ও বরিশালে ২ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারাদেশে ৫৫৪টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ হাজার ৬২৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২৪ হাজার ৪০০টি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ-মৃত্যু বাড়তে থাকে। মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের অনেকের মতে, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এ সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এই দুটি দেশের ভ্যারিয়েন্ট এতটা সংক্রমণপ্রবণ ছিল যে, আগের বছরের জুন-জুলাই মাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে মানুষ আক্রান্ত ও মারা যান। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ কিছুটা কমতে থাকে। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ কিছুটা কম ছিল। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দেশে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা যায়, করোনার ভারতীয় নতুন ধরন 'ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট'-এ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি উচ্চ সংক্রমিত সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এরপর সীমান্ত জেলা থেকে ধাপে ধাপে সংক্রমণ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপের আওতায় একদল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করছেন। তারা দেশে করোনা সংক্রমণের পূর্বাভাস নিয়ে একটি সম্ভাব্য চিত্র এঁকেছেন। গাণিতিক মডেল বিশ্নেষণ করে তারা যে পূর্বাভাস দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আগামী জুলাই মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরেকটি পিক বা সর্বোচ্চ চূড়ায় যেতে পারে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার করে শনাক্ত এবং ১০০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি দেখে সরকার প্রথমে ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। কিন্তু তাতেও মানুষের ঢাকায় ফেরা কিংবা ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরা আটকানো যায়নি। পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। এ অবস্থায় গত শুক্রবার রাতে এক প্রেস নোটে আজ সোমবার থেকে আগামী সাত দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণার কথা জানানো হয়। কিন্তু শনিবার রাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত আসে। আর গতকাল রোববার নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে। তবে সরকারের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থ ছাড়সহ বিল পরিশোধের বিষয় রয়েছে। দেশব্যাপী ব্যাংকগুলো এ কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকবে। এ অবস্থায় কঠোর লকডাউন দিলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধের পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ঘোষণা দিয়েও কঠোর লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে। সীমিত পরিসরে বিধিনিষেধের নামে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তা হাস্যকর। অফিস-আদালত খোলা থাকবে আর রাস্তায় পরিবহন থাকবে না। এটি কীভাবে কার্যকর হবে? কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসতেই ঢাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে ছুটছেন। আবার গ্রাম থেকে ঢাকায়ও ফিরছেন। সুতরাং এ পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে। মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থেই কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে লকডাউন দিতে হচ্ছে। কারণ, টিকাকরণ করার আগ পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউন একমাত্র পন্থা। লকডাউনে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট হয়। অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরপরও লকডাউন দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সুতরাং সবার প্রতি আবারও আহ্বান থাকবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করুন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না।

করোনার উপসর্গে মৃত্যু বাড়ছে: ব্যুরো, অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি উপসর্গে মৃত্যুও আগে চেয়ে বেড়েছে।

খুলনায় গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৯০৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত এক হাজার ২০২ জন। শনাক্তের হার ৪০ শতাংশ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে রাজশাহীর চার, নাটোরের চার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের দু'জন। তাদের একজন করোনা পজিটিভ ছিলেন, আটজনের উপসর্গ ছিল এবং একজন করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর মারা গেছেন।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নারী ও এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ফোকাল পারসন ডা. মহিউদ্দিন খান জানান, এই সময়ে উপসর্গ নিয়ে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে।

রংপুর বিভাগে মারা যাওয়াদের মধ্যে রংপুরের একজন, লালমনিরহাটের এক, ঠাকুরগাঁওয়ের চার ও দিনাজপুরের দু'জন রয়েছেন। সিলেটে মারা যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সিলেট জেলার বাসিন্দা এবং দু'জন সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের। বাগেরহাটে গত ২৪ ঘণ্টায় ৪১৩ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত ১৭৭। শনাক্তের হার ৪৩ শতাংশ। এই সময় করোনায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। চুয়াডাঙ্গায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এবং উপসর্গ নিয়ে আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মেহেরপুরে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ নিয়ে জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ৪৪।