কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে; বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মাছ, ফল, সবজি ও বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটলেও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। রপ্তানি প্রক্রিয়া, বাণিজ্যিকীকরণ ও বহুমুখীকরণও জোর পাচ্ছে না। নেই পর্যাপ্ত প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ। সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ নষ্টও হচ্ছে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা।
তবে সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বেড়েছে বরাদ্দও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর বছর কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়লেও সমন্বয়হীনতার কারণে এ কার্যক্রমে গতি আসছে না। দেশ ফসল উৎপাদনে যতটা পারদর্শিতা অর্জন করেছে, সে অনুপাতে উৎপাদন-পরবর্তী প্রক্রিয়া সামলানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
কৃষির শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে জোর দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তার মধ্যে সমন্বয়, পরিবহনে টোল চার্জ কমানো, সরকারি নজরদারি বাড়ানো, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং কৃষিপণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এবারের বাজেটে কৃষিভিত্তিক শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফল ও শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাত শিল্প, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন শিল্পে শর্তসাপেক্ষে ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য সুরক্ষায় বিশেষ করে গাজর আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। মাশরুম আমদানিতে শুল্ক্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
নতুন বাজেটে কৃষির আধুনিকায়নে কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক্ক হার কমানো হয়েছে। গবাদি পশু খামারিদের সুরক্ষায় প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানিতে নতুন করে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিতে স্টেইনলেস স্টিল আমদানিতে শুল্ক্ক প্রতি টনে ১৫০০ থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করা
হয়েছে।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ৬৮০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, কৃষিজাত পণ্য আমদানির বিকল্প তৈরির মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থান সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণও কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিদেশফেরত শ্রমিক ও করোনাকালে কাজ হারানো মানুষকে কৃষিতে বিনিয়োজিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার যে স্টার্টআপ তহবিল আছে, সেখান থেকে এ নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করা যেতে পারে।
ফসলের বহুমুখীকরণ পিছিয়ে :কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশে রয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বছরে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৬০ লাখ টন। সবজি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, মান নিয়ে কড়াকড়ির কারণে ২০১৭ সালের মার্চে ইইউতে সবজি রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হওয়ায় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পান রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। অবশ্য গত ২৬ মে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ইউরোপে পুনরায় পান রপ্তানি শুরু হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সবজি রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সবজি রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কভিড পরিস্থিতির কারণেই রপ্তানি কমেছে বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। ৫০ বছরে আলু উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১১ গুণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে গত অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টন। কিন্তু রপ্তানিযোগ্য আলুর অভাব, পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার না থাকা এবং প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা না থাকায় আলুর দাম পাচ্ছেন না কৃষক। আলু বিক্রি করতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পচে নষ্টও হচ্ছে। সরকারের পরামর্শে এবার কৃষকরা প্রচুর ব্রোকলি উৎপাদন করেও দাম পাননি। দাম না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে তা গরুর খাওয়ানো হয়েছে।
ফল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বছরে ফল চাষের জমি বাড়ছে ১০-১১ শতাংশ হারে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় ও আমে সপ্তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। তবে এ অর্জনের উল্লেখযোগ্য অংশই বিফলে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশে এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ লাখ ৫০ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আম উৎপাদিত হয় ১২ লাখ ২২ হাজার টন। বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩১ টন আম রপ্তানি হয়। পরের বছর বেড়ে ৩০৮ টনে দাঁড়ায়। গতবার করোনার কারণে আম রপ্তানি হয় ২৭৮ টন। চলতি বছর ৯০০ টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রপ্তানিকারকদের। অথচ পাকিস্তানে মাত্র ৮ লাখ টন আম উৎপাদন হলেও তারা মধ্যপ্রাচ্যে এক লাখ টন আম রপ্তানি করে।
এদেশে আম চাষের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও এ খাতটি শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি। আমের বহুমাত্রিক বাণিজ্যিকীকরণেও নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারতে আমের মৌসুমে জুসসহ বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে রাস্তাঘাট-হাটবাজার এখন আমে সয়লাব। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০-৬০ টাকায়।
অধিক উৎপাদনের ফলে রাজধানীর ফুটপাতে মাত্র ২০০ টাকা কেজিতেও ড্রাগন ফল বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহীর নওহাটার পুঠিয়াবাড়ির আমচাষি জুয়েল রানা বলেন, দেশীয় দুয়েকটি কোম্পানির আম থেকে জুস উৎপাদন ছাড়া সংরক্ষণের আর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। করোনাকালে আম এবার পচে নষ্ট হচ্ছে।
কারিতা কেআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুরজিত বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের আমে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট হয় না। এ ছাড়া আমে পোকা হওয়ার কারণে বাংলাদেশ রপ্তানিতে পিছিয়ে আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ বলেন, বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ফলের চাষ হওয়া এলাকাতে অত্যাধুনিক ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ভিএইচটিপি) বাস্তবায়নে পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। এ প্লান্টের আওতায় নিরাপদ পদ্ধতিতে যে কোনো ফল সংগ্রহ করে গ্রেডিং করে আয়োডাইজড পানিতে ধোয়া হবে। তার পর নির্দিষ্ট ফলের জন্য উপযুক্ত ও সহনীয় তাপমাত্রায় বাষ্পীয় প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে প্যাকেটজাত করে রাখা হবে কুলিং সিস্টেমে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ফলের রপ্তানি বাড়াতে চলতি মাসে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। রপ্তানির জন্য উৎপাদিত শস্যের গুণগত মানের অভাব, নিরাপদ শস্য উৎপাদনের অভাব, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, চুক্তিভিত্তিক কৃষক না থাকা, অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, তদারকি ও মান সনদের দুষ্প্রাপ্যতা, রপ্তানির জন্য বিশেষ অঞ্চল না থাকাসহ ২০ ধরনের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে তারা।
প্যাকিং হাউস কাজে আসছে না :ঢাকার শ্যামপুরে কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের 'বাংলাদেশে ফাইটোস্যানিটারি সামর্থ্য শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের' অধীনে ১ একরের একটি প্লটের ৬০ শতাংশ জমির ওপর সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউস করা হয়। তবে এটি তেমন কাজে আসছে না বলে অভিযোগ করেন ফল ও সবজি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিএফভিএপিইএর সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ।
তিনি বলেন, শ্যামপুর থেকে বিমানবন্দরে যেতে যানজটের কারণে ৫-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ভারত সবজি রপ্তানির জন্য আলাদা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) করেছে। এ দেশে কৃষি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করার জন্য বড়-সড় জায়গা নির্বাচন করা যায়। কৃষকরা সেখানে চাষ করবেন। ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে কিনে নেবেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক প্যাকিং হাউস স্থাপনে পূর্বাচলে ২ একর জমি কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন। সেখানে কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক প্যাকিং হাউস এবং অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেই ২ হাজার ১০০ কৃষক সমবায় সংগঠন রয়েছে। জাপানে একটা ফুলকপি কোন কৃষক উৎপাদন করছেন, তাও পণ্যের গায়ে লেখা থাকে। কৃষক নিজেই জাপান এগ্রিকালচার আউটলেটে পণ্য বিক্রি করেন। বর্তমানে ভারতেও পল্লী জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষক সমবায়ের উপকারভোগী। বাংলাদেশেও কৃষক-ক্রেতা মিলে এমন সেতুবন্ধ তৈরি করা দরকার।