১৯৭১ সালের জুন মাসের মধ্যভাগ পেরোলে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-তরুণ ও কৃষকসন্তান গেরিলাদের সশস্ত্র আঘাতে-আঘাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্রমাগত ক্ষয়ক্ষতি ও তাদের ঘুম হারাম হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার 'রাজনৈতিক সমাধান'-এর নামে মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান রক্ষায় যে কারসাজি করছিল, তাও স্পষ্টত ভেস্তে যায়। সে সময় ২৮ জুন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সৃষ্টি করেন এক 'রাজনৈতিক ধূম্রজাল'। তিনি সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন বেসামরিক সরকার গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যাতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা করে ঘোষণা দেওয়া হয় উপনির্বাচনেরও। তবে মুজিবনগর সরকার তার এই ধূম্রজাল ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। ৩০ জুন ইয়াহিয়ার পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দলটির সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি ইয়াহিয়া খান। বরং একের পর এক কূটচালের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ব বাংলায়, অর্থাৎ বাংলাদেশে শুরু করেন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারীদের ওপর নৃশংস নারকীয়তা। গ্রেপ্তার করেন বঙ্গবন্ধুকেও। শুরু হয় দেশব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।
এ পর্যায়ে পাকিস্তানের কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। মুজিবনগর সরকারের তৎপরতায় বিশ্ব জনমত ক্রমেই স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আসতে শুরু করে। অন্যদিকে মুজিবনগর সরকারের পথচলা রুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে নানা ধরনের কূটকৌশল নিতে থাকেন সামরিক শাসক ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।
২০ জুন ব্রিটেনের সানডে টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় পাঁচ কলামব্যাপী এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিকভাবে যাকে যাকে বিপজ্জনক মনে করছে, তাদের হত্যা করছে। এ ছাড়া সাদা, ধূসর ও কালো- তিন ধরনের তালিকা প্রণয়ন করেছে। সাদা তালিকার ব্যক্তিদের বেকসুর খালাস, ধূসর তালিকার ব্যক্তিদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আর কালো তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে নানা কর্মসূচি নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন প্রবাসী বাঙালিরা।
রণাঙ্গনেও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ তীব্র হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বাঙালিদের প্রবল আপত্তির মুখে ২৫ জুন পাকিস্তানে ৯ হাজার ডলারের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ-সংক্রান্ত দুটি লাইসেন্স বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের জন্য ৩১ মার্চ ও ৬ এপ্রিল এ লাইসেন্স দুটি মঞ্জুর করা হয়েছিল।
২৮ জুন ভারত থেকে প্রকাশিত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় 'মুক্তিফৌজ দুই দিনে ৬০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, 'গত দুই দিনে বাংলাদেশের পূর্ব সেক্টরে তীব্র গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে মুক্তিফৌজ কমপক্ষে ৬০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছে এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করেছে।' প্রতিবেদনের আরেক অংশে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টরে কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা শহরে মুক্তিফৌজ অ্যামবুশ করে একজন অফিসারসহ পাঁচজন পাকসেনাকে হত্যা করেছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ যখন তুঙ্গে, ঠিক সেইক্ষণে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে প্রকাশ্যে ফের নতুন কূটচাল নিয়ে আবির্ভূত হন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ২৮ জুন জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি দাবি করেন, 'বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে এসে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান, যা তার দুরভিসন্ধির ইঙ্গিত বহন করে। সমগ্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক আচরণ করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। তিনি এরই মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছিলেন- চাতুর্য বা সহিংস উপায়ে তিনি দেশকে দুই ভাগে ভাগ করবেন।' এমন সব অভিযোগ করে ইয়াহিয়া তার ভাষণে আরও বলেন, 'আমি স্পষ্টভাবে প্রথমেই বলতে চাই, কোনো নতুন নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। কিছু বিপথগামী ব্যক্তির দুস্কৃতির জন্য বিপুল অর্থ, সময় ও শক্তি ব্যয়ে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্ণরূপে বাতিলও ঘোষণা করা হবে না। যদিও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি; কিন্তু এই বাতিলকৃত দলের সদস্য যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে। যদিও যেসব নির্বাচিত সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী বা অপরাধমূলক বা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন, তাদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ আমি বাতিল ঘোষণা করব।' অর্থাৎ ইয়াহিয়া এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে কার্যত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিজয়ী সব সদস্যের আসন শূন্য করার ঘোষণা দেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তখন বিজয়ী সব সদস্যই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন।
ইয়াহিয়া এদিন শূন্য আসনে উপনির্বাচন আয়োজন এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ফের সংবিধান প্রণয়নেরও ঘোষণা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ভারতের সমালোচনা করার পাশাপাশি তিনি চার মাসের মধ্যে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ক্ষমতা হস্তান্তরেরও আশা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া বাঙালিদের সশস্ত্র সংঘাত (মুক্তিযুদ্ধ) পরিহার করে আপসেরও ইঙ্গিত দেওয়া হয় তার ভাষণে। যদিও এর কোনোটিই হয়নি; বরং ছয় মাসের মাথায় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নেন ইয়াহিয়া খান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশ্নে সরব ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ইয়াহিয়ার ভাষণ এবং যুদ্ধরত বাঙালিদের আপসের প্রশ্নে ২৯ জুন সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এ বিষয়ে 'স্বাধীনতার বিষয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয় :ভাসানী' শীর্ষক ভারতের নয়াদিল্লি থেকে 'দি হিন্দুস্তান টাইমস'-এর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সেখানে বলা হয়, 'বাংলাদেশ সংক্রান্ত রাজনৈতিক মীমাংসা নিয়ে কোনোরকম আপস নয়।' একটি সংবাদ সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পুনরাবৃত্তি করলেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যতই গভীর ষড়যন্ত্র হোক না কেন, তা ব্যর্থ হওয়া নিশ্চিত ছিল। তিনি বললেন, 'বাংলাদেশের জনগণ যখন তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে, যখন তাদের নারীদের সম্মানহানি হয়েছে, যখন তারা তাদের স্বাস্থ্য এবং বাড়ি হারিয়েছে এবং তাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং তাদের ১০ লাখ মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে, তখন তারা রাজনৈতিক মীমাংসার নামে ধোঁকাবাজি গ্রহণ করবে না।' তিনি পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্রের পাশাপাশি কূটনৈতিক সহায়তা দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রেরও তীব্র সমালোচনা করেন।
এদিন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষিত আওয়ামী লীগদলীয় পরিষদ সদস্যদের আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, অখণ্ড পাকিস্তান এখন মৃত এবং ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। স্ব-আরোপিত একনায়ক ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেই। কামারুজ্জামান আরও বলেন, ইয়াহিয়া নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারই বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। আমরাই বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের জনগণ আমাদের ছাড়া কোনো বিদেশি সরকারের চাপিয়ে দেওয়া শাসনতন্ত্র মেনে নেবে না। আমরা দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিসংগ্রাম করেছি এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী শত্রুকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণ আওয়ামী লীগের পেছনে রয়েছে। মুক্তাঞ্চল বাংলাদেশ সরকারের কেবল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণেই নেই, সেখানে বেসামরিক প্রশাসন স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করছে।
একই দিন পাকিস্তানের আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি (মুহাম্মদ আতাউল গনি) ওসমানীকে তার অনুপস্থিতিতে সামরিক আদালতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার কথা জানানো হয়।
৩০ জুন স্বাধীন বাংলা বেতারে ইয়াহিয়ার ভাষণের পাল্টা জবাব দেন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। 'ইয়াহিয়া রণক্ষেত্রে জবাব পাবে :সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির বেতার বার্তা' শিরোনামে ভারত থেকে প্রকাশিত দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলা হয়, 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা ইয়াহিয়া খানের বেতার বার্তার যথোপযুক্ত জবাব রণক্ষেত্রেই দেবে। বাংলাদেশের বেতারে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এক বিবৃতিতে আরও বলেছেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার যোগ্যতা রাখে না। প্রায় সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধা তার ঘৃণা ও বিতৃষ্ণাভরা বক্তব্য শুনেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, 'আমরা বর্তমানে একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে অবস্থান করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের ভূমি হতে বিদেশি সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন না করব, ততক্ষণ আমরা বিশ্রাম করব না।'
অন্য একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ নজরুল ইসলামের উদ্ৃব্দতি দিয়ে বলা হয়, 'বাংলাদেশের জনগণ ইয়াহিয়ার ভাষণকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে একটি নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।' আর এমন সব ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যায় মুক্তিবাহিনী।