- বাংলাদেশ
- ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাওয়া’
‘সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধ ভুলে যাওয়া’

আলোচনা সভায় অতিথিরা
ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। বুধবার সান্তাল বিদ্রোহের ১৬৬তম বর্ষপূতি উপলক্ষে আইপিনিউজের আয়োজনে অনুষ্ঠিত অনলাইন আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি। আদিবাসী সাঁওতালরা নিজেদের ‘সান্তাল’ বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সুলভ চাকমার সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ প্রমুখ।
রাষ্ট্রীয়ভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস পালন না হওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে এ প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, ঔপনিবেশ বিরোধী প্রথম গণসংগ্রাম সান্তাল বিদ্রোহ। এটাকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম হিসেবে তুলে ধরা যায় না। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা সান্তাল বিদ্রোহ। এ চেতনা যদি আমরা ধরে রাখতে না পারি, তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা আমাদের ব্যর্থতা। সান্তাল বিদ্রোহের নেতারা কেবল সান্তাল নেতা নন, তারা জাতীয় নেতা। তাদের ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া।
তিনি বলেন, সান্তালরা মূলত ব্রিটিশ-দালাল, সুদখোর, মহাজন ও নিপীড়নকারীদের কাছ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। এখনও প্রান্তিক আদিবাসী, গরিব ও নিপীড়িত বাঙালিরা তাদের কাছ থেকে মুক্তি চায়। সান্তাল বিদ্রোহের জাতীয় বীরদের আকাঙ্ক্ষা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের নিপীড়িত সান্তাল এবং বাঙালিরা এখনও বিচার পায়নি এবং বাপ-দাদার জমি এখনও ফেরত পায়নি বলেও মন্তব্য করেন ন্যাপের এ সভাপতি।
আলোচনায় যুক্ত হয়ে অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেসব প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছিল তার প্রধান মাইলফলক সান্তাল বিদ্রোহ। এ আন্দোলনের প্রধান দিক হচ্ছে অন্যান্য সব আন্দোলন স্থানীয় পর্যায়ে থেকে গেলেও সান্তাল বিদ্রোহ বাংলা, বিহার, ওডিশা এবং দিল্লি পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিল। ব্রিটিশদের কাছে এটি ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ বিদ্রোহের আত্মবলিদান সুবিশাল এবং অন্তত ২০ হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন এ ইতিহাসবিদ।
সান্তালদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তরুণদের দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন ভারতের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোৎস্না চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, সান্তাল বিদ্রোহ বা হুল বিদ্রোহ ভূমিজ মানুষেরই অধিকারের কথা। শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতিগতভাবে তাদের উপক্ষো করা হয়। তাদের অধিকাররের জায়গাটা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এতবছরের সভ্যতার ধারক-বাহক যারা, তাদের বিচ্ছিন্ন কিছু সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরা হলেও প্রকৃত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।
সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, সিদু-কানুরা যে আন্দোলন করেছেন, আমরা বাংলাদেশেও আদিবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতির অধিকার, ভূমির অধিকারের জন্য লড়ছি। সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমি উদ্ধাররের আন্দোলনে নিপীড়িত বাঙালিরাও আছেন।
যুবনেত্রী চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, আমরা আশায় থাকি এ রাষ্ট্র ঐতিহাসিক এসব দিবস পালন করবে। কিন্তু কেবল আদিবাসী এবং প্রগতিশীল বাঙালি সমাজ এটি পালন করে। দেশের আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিকৃত করে সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পাঠ্যপুস্তক বা অন্য জায়গাগুলোতে রাষ্ট্র কখনও আদিবাসীদের গৌরবময় অধ্যায়কে সেভাবে তুলে ধরতে পারেনি।
আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং বলেন, ব্রিটিশদের সময়ে সান্তালদের জমিগুলো নামে-বেনামে লিজ দিয়ে তারা এগুলো হরিলুট করেছে। ঠিক তেমনি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের সান্তাল আদিবাসীদের ওপরও একই ধরনের নিপীড়ন করা হয়েছে। অবিলম্বে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি করেন এ আদিবাসী নেতা।
আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ বলেন, ব্রিটিশরা যেভাবে অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন করেছিল, ঠিক একই কায়দায় জোর-জবরদস্তি করে সান্তালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের অত্যাচার করছেন শাসকরা। সিদু-কানু-চাঁদ-ভৈরব যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন, সেই লড়াই এখনও আদিবাসীরা লড়ছেন বলেও মনে করেন এ আদিবাসী ছাত্রনেতা।
মন্তব্য করুন