রাজশাহীর মোহনপুরে মেসার্স মজিদ সরকার রাইস মিলে কাজ করেন ৫০ জনের মতো স্থানীয় শ্রমিক। ২০১৫ সালের অক্টোবরে চালকলটি সরেজমিন পরিদর্শনে যান কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) সহকারী মহাপরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম। পরিদর্শনে তিনি দেখেন, চালকলটি শ্রম আইনের কোনো ধার ধারে না। ট্রেড লাইসেন্স নেই। চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে আগুনের তাপে কাজ করেন শ্রমিকরা। এর পরও নিয়মিত মজুরি হয় না। শ্রম আইনের ১২টি ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পান তিনি। নিজে বাদী হয়ে মেসার্স মজিদ সরকার রাইস মিলের মালিক আব্দুল মজিদের বিরুদ্ধে রাজশাহী শ্রম আদালতে মামলা করেন। মামলা দায়েরের দুই মাসের মাথায় রায় আসে। রাইস মিলের মালিককে জরিমানা করা হয় মাত্র এক হাজার টাকা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ওই বছর নওগাঁর সুমি চানাচুর কারখানার মালিককে একই অভিযোগে মাত্র ২০ টাকা জরিমানা করা হয়।
শ্রম আইনে বলা হয়েছে, শ্রম নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারা অমান্য করলে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। সর্বনিম্ন কত জরিমানা করা যাবে, আইনে তা সুস্পষ্ট নয়। মামুলি জরিমানার কারণে নিরাপত্তার তোয়াক্কা করছেন না কারখানা মালিকরা। আইনি দুর্বলতার পাশাপাশি সক্ষমতা এবং সদিচ্ছার অভাবে ডিআইএফই নিজেই এক ধরনের অসহায়ত্বের মধ্যে আছে।
শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা এবং শ্রমজীবীর আইনগত অধিকার, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব ডিআইএফইর। কিন্তু তাদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। পরিদর্শনে যত বড় অনিয়মই হোক, কারখানা কর্তৃপক্ষকে সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে একটা নোটিশ দেওয়ার ক্ষমতা আছে ডিআইএফইর। বড়জোর শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করা সম্ভব তাদের পক্ষে। এমন একটি ক্ষমতাহীন প্রতিষ্ঠানের ওপর সারাদেশের সব শিল্পকারখানা ও শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এক কোটি ৪১ লাখ চার হাজার ৭৫৩ জন শ্রমিক কাজ করছেন এসব প্রতিষ্ঠানে। ডিআইএফই মাত্র ৩২০ জন পরিদর্শক দিয়ে এসব শিল্প এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ফলে জবাবদিহিতা এবং নজরদারিবিহীন পরিবেশে নিরাপত্তায় নজর না দিয়ে যেনতেনভাবে শিল্প চালাতে কোনো মালিকের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের মতো কোনো পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ কিংবা সংস্কারে কোনো ধরনের চাপও নেই। ফলে উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে যুগের পর যুগ চলছে সারাদেশের ছোট-বড় সব কারখানা। পরিণাম যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। নিয়মিত ঘটছে শিল্প দুর্ঘটনা। অসহায়ভাবে মারা যাচ্ছে শ্রমিক। এর সর্বশেষ উদহারণ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডসের কারখানায় অগ্নি দুর্ঘটনায় ৫২ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু।
বাংলাদেশ লেবার স্টাডিজের (বিলস) জরিপ মতে, গত জুন পর্যন্ত গত সাড়ে চার বছরে বিভিন্ন শিল্প খাতে ৯৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১৭ শ্রমিক। আহত হয়েছেন ২৭৫ জন। পোশাকবহির্ভূত খাতেই বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যার সংখ্যা ৯১টি। হাসেম ফুডস ছাড়া গত ছয় মাসে ১৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক নাসির উদ্দিন সমকালকে বলেন, শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রধান দায়িত্ব তার সংস্থার। তবে আইনি সীমাবদ্ধতা এবং লোকবলের সংকট নিয়ে ডিআইএফইর পক্ষে সারাদেশের প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা মনিটর করা সম্ভব হয় না। কোনো কারখানায় নিরাপত্তা ত্রুটি পাওয়া গেলে মামলা করা ছাড়া কোনো প্রতিকার তারা নিতে পারেন না। বড় ধরনের নিরাপত্তা ঘাটতি পেলে কারখানা সিল করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকা দরকার।
সারাদেশের কারখানার নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে- জানতে চাইলে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, ডিআইএফইর জনবল বাড়ানো, প্রযুক্তি সুবিধা দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব পর্যায়ে তাদের শক্তিশালী করতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ডিআইএফইকে। বেসরকারি পর্যায় থেকে চিন্তা ও গবেষণা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে হবে।
ডিআইএফইর কর্মকর্তারা জানান, শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থারও কর্তব্য রয়েছে। শিল্প উৎপাদনের প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স দেয় স্থানীয় সরকার। একই কর্তৃপক্ষ থেকে ভবন নির্মাণের অনুমতি নিতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে কারখানা ভবনের অবস্থানগত সনদ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এ পর্যায়ে কারখানা নির্মাণ হলে আশপাশে পরিবেশের ওপর প্রভাব তদারক করে অনুমতি দেয়। ভবন নির্মাণ হলে পরিবেশসম্মত উপায়ে নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তার জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারও সনদ নিতে হয় পরিবেশ অধিপ্তর থেকে। অগ্নিনিরাপত্তার সনদ দেয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। কারখানা হলে মেশিন স্থাপনের নকশা অনুমোদন নিতে হয় ডিআইএফইএ থেকে। উৎপাদনে যাওয়ার ১৫ দিন আগে সনদ নিতে হয় ডিআইএফইএ থেকে। সর্বশেষ উৎপাদনে যাওয়ার আগে ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হয় এনবিআর থেকে। নিরাপত্তা মান যাচাই করেই এসব প্রতিষ্ঠান সনদ দেওয়ার কথা। ফলে কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার দায় এসব প্রতিষ্ঠানেরও রয়েছে।
পরিদর্শন পরিকল্পনার আওতায় নেই ৯৫% প্রতিষ্ঠান : ডিআইএফইর পরিদর্শন পরিকল্পনার আওতায় দেশের ৯৫ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্থার পরিদর্শন পরিকল্পনা জেলাভিত্তিক অগ্রাধিকার তালিকায় দেখা যায়, ঢাকা জেলার বস্ত্র, পাট ও ট্যানারি শিল্প খাতের মাত্র ৪ শতাংশ কারখানা পরিদর্শনের পরিকল্পনা ছিল। লোকবলের অভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিদর্শনও বেশিরভাগ সময়ই সম্ভব হয় না। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর অনুসন্ধানী পরিদর্শন এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু করোনা সুরক্ষা সামগ্রী এবং মজুরি নিয়মিত কিনা- এ দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
দেশের সব জেলায় ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তদারকির জন্য ডিআইএফইর কার্যালয় বা কার্যক্রম নেই। মাত্র ২৩ জেলায় সংস্থার অফিস আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের লোকবল বাড়ানোর নির্দেশনা দেন। এর পর দুই হাজার ৭০০ পরিদর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় পাঁচ বছর আগে। কিন্তু এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব বাবুল আখতার সমকালকে বলেন, ডিআইএফই বেশ দুর্বল প্রতিষ্ঠান। একে শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ করতে হবে। তাদের জবাবদিহিতার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিলসের নির্বাহী কমিটির সদস্য শাকিল আখতার চৌধুরী সমকালকে বলেন, নখদন্তহীন ডিআইএফই দিয়ে শিল্পের নিরাপত্তা হবে না। তাদের সেই সক্ষমতা নেই। লোকবল না থাকার জন্য তারাই দায়ী। শ্রম আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তাদের হাতে না থাকার জন্যও তারাই দায়ী। তার অভিযোগ, হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানাটি নিয়মিত পরিদর্শন করেনি ডিআইএফই। শিল্প এবং শ্রমিকের নিরাপত্তায় ডিআইএফইর বিকল্প উপায় ভাবতে হবে।
পোশাক খাতে উন্নতি :২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৬ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক পঙ্গু হন। দুর্ঘটনার পর ইউরোপভিত্তিক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা জোট বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি বা অ্যাকর্ড গঠিত হয়। প্রায় একই সময়ে উত্তর আমেরিকার ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি বা অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। যেসব কারখানা থেকে জোট দুটি পোশাক সংগ্রহ করত, সেসব কারখানা পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। সরকার এবং বিজিএমইএর সহায়তায় পরে সংস্কার পরিকল্পনা অনুযায়ী চিহ্নিত সব ত্রুটি সারিয়ে তোলা হয়। সাত বছরের সেই কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে।
তবে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের বাইরে থাকা কারখানার সংস্কার উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিআইএফইর ওপর। অধিদপ্তরের নেতৃত্বে রেমিডিয়েশন কোঅর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) নামে আলাদা একটি সেল গঠন করা হয়। প্রায় ৯০০ কারখানা নিয়ে কাজ শুরু করে আরসিসি। আইএলওর পক্ষে অর্থসহায়তাও দেওয়া হয়। শতভাগ সংস্কার আজ পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি। এসব কারখানার মালিকদের অনেকেই আরসিসির কোনো কথাই শুনছে না।

বিষয় : কারখানা নিরাপত্তা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন

মন্তব্য করুন