
শুক্রবার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার তুলে দেওয়া হয়- প্রতিবেদক
তাছলিমা বেগমের চোখ-মুখে আনন্দের হাসি। এক ছেলে, তিন মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে ভাসানচরে তার সংসার। বসবাস করছেন ২৩ নম্বর ক্লাস্টারে। রোহিঙ্গা হলেও প্রায় প্রমিত বাংলা উচ্চারণে কথা বলেন তিনি, 'মুরগি পালন করে সংসারের জন্য আয় করতে চাই। আমরা খুব খুশি। সরকার জীবিকার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে যেমন ব্যস্ত থাকা যাবে, তেমনি কিছু টাকাও হাতে আসবে।'
ভাসানচরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য গতকাল শুক্রবার হাঁস-মুরগি, ছাগল, সেলাই মেশিন, মাছ ধরার জালসহ নানা ধরনের সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সকাল থেকে খোলা মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এসব সামগ্রী নেন তারা। কারও কারও অভিব্যক্তি ছিল এমন যেন ঈদের আগেই তাদের কাছে এসেছে 'ঈদ আনন্দ'।
জীবিকার অবলম্বন পেয়েছেন মো. জুবায়ের। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর এই যুবক একসময় আশ্রয় নিয়েছিলেন কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে। সেখানে নরসুন্দর হিসেবে ভালোই পরিচিতি ছিল তার। কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নতুন ঠিকানায় আসার পর পুরোনো পেশায় ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভালো সরঞ্জাম না থাকায় সেখানে এতদিন হয়ে ওঠেনি। গতকাল চুল কাটার সরঞ্জাম পেয়ে দারুণ খুশি তিনি।
ভ্যান পেয়ে নতুন স্বপ্নের কথা জানালেন অলি হোসেন। ২৩ নম্বর ক্লাস্টারের জি-৭ নম্বর কক্ষ তার ঠিকানা। স্ত্রী জাহিদা বেগম, ছেলে তারেক (৬) ও মেয়ে রোমেনাকে (৭) নিয়ে তার সংসার। নতুন ভ্যানের হাতল শক্ত করে ধরে রাখছিলেন অলি। তিনি বললেন, 'নতুন একটি ভ্যান পাব- এটা কল্পনায়ও ছিল না। ভ্যান চালিয়ে যে উপার্জন করব, সেটা দিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোভাবে সংসার করতে পারব। কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্পে ছিলাম। সেখান থেকে ভাসানচরের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো।'
আট মাসের ছোট্ট শিশু নুর আংকিসকে নিয়ে ওয়্যারহাউসের সামনে লাইনে ছিলেন আয়েশা বেগম। সেলাই মেশিন পেয়েছেন তিনি। আয়েশা বললেন, 'ঘরে আমি সেলাইয়ের কাজ করব আর জামাই নদীতে মাছ ধরবে। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে ভালোভাবে সবকিছু চলে যাবে।'
ভাসানচরে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন করে দেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঈদের আগে ১৩ ধরনের সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ৮০০ জনকে মাছ ধরার জাল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেওয়া হয়েছে ৫০টি ভ্যান, পাঁচ হাজার দেশি হাঁস, পাঁচ হাজার দেশি মুরগি, ৪৫ সেট চুল কাটার সরঞ্জাম, ২৮ সেট জুতা সেলাইয়ের সরঞ্জাম, ১০০টি সেলাই মেশিন, ২৫ সেট রিকশা-ভ্যান মেরামতের সরঞ্জাম, ইলেক্ট্রিশিয়ানের মেশিনপত্র সাত সেট, কাঠমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি ৫০ সেট, মুদি দোকানের জিনিসপত্র দেওয়া হয় ১০০ জনকে, দেশি ছাগল ১০০টি, ২০০ জনকে দেওয়া হয় মাছের পোনা। তারা ভাসানচরের ২০টি পুকুরে চাষ করবেন। এতে সব মিলিয়ে দুই হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা ও তাদের পরিবারের জন্য কর্মসংস্থানের পথ তৈরি হয়েছে।
আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের পরিচালক কমডোর এম রাশেদ সাত্তার বলেন, এরই মধ্যে ভাসানচরের আড়াই হাজারের বেশি রোহিঙ্গার জীবন নির্বাহের ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে এর আওতায় নিয়ে আসা। আবার অনেক রোহিঙ্গা ভাসানচরের এই প্রজেক্টে কাজ করে।

রাশেদ সাত্তার আরও বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে আমরা ভাগ করেছি। কৃষি, মৎস্য, খাবার আইটেম ছাড়াও আর অনেক কিছু আছে। জীবিকা নির্বাহের সরঞ্জাম পাওয়ায় রোহিঙ্গারা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তাদের সময় ভালো কাটবে, আবার উপার্জনও হবে। তবে এমন কিছু রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা কোনো ধরনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির মধ্যে আসতে চান না। কারণ তাদের পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে উপার্জন করে।
জীবিকা নির্বাহের সরঞ্জাম পেয়ে খুশি হলেও তাদের অনেকেরই কণ্ঠে ছিল নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার আকুতি। এমন একজন রুখিয়া বেগম। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। বাংলাদেশের সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তবে নিজেদের ঠিকানা ছাড়া আর কতকাল? দেশে ফিরতে পারলেই আমরা বেশি খুশি হব।
সাত-আট বছরের শিশু সৈয়দা বেগমের সঙ্গে তার নানি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। হাঁস পেয়ে নানি-নাতনি ভীষণ খুশি। সৈয়দা বলল, বাসার সামনে বড় জায়গা। খোলামেলা পরিবেশ। সেখানে হাঁস পালব। হাঁসে ডিম দেবে। কী মজাই না হবে।
কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের একটি অংশে স্থ্থানান্তর করতে সরকার নোয়াখালীর হাতিয়ায় ভাসানচরে নির্মাণ করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা; যেন সাগরের মোহনায় সুন্দর এক নগর। এখানে রয়েছে এক হাজার ৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি ঘর। প্রতি ঘরে আছে ১৬টি কক্ষ। একেক কক্ষে চারজন করে থাকার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এখন ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার থাকার ব্যবস্থা আছে।
বায়োগ্যাস প্লান্ট, সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ নানা আধুনিক সুবিধাও রয়েছে ভাসানচরে। রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। চরটি বসবাসের উপযোগী করা, অবকাঠামো নির্মাণ, বনায়নসহ প্রকল্পটির সার্বিক কাজ করে নৌবাহিনী।
মন্তব্য করুন