শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও হার মানেননি তারা
.
সাজিদা ইসলাম পারুল
প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০০:১২ | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৯:০৯
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নূরজাহানের চলার পথ মসৃণ ছিল না। স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়– প্রতিটি প্রাঙ্গণেই টিকে থাকতে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আইন অনুষদে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পড়ার সুযোগ তৈরি হলে নূরজাহান ভর্তি হন সেখানে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি ভালোভাবে এলএলবি, এলএলএম পাস করেন। তারপর শুরু হয় কর্মজীবনে প্রবেশের যুদ্ধ। প্রথমেই বিচারক পদে নিয়োগের জন্য ফরম কিনতে গেলে বাধা পান নূরজাহান। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বারের সদস্য পদ পান। আইনজীবী হিসেবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার আদায়ে উপস্থিত হন আদালতে।
প্রতিবন্ধকতার শতসহস্র পথ পাড়ি দিয়ে আরেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাস্কর ভট্টাচার্য হয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আইসিটি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (অ্যাকসেসিবিলিটি)। তিনি বলেন, অনেক বাধা-প্রতিবন্ধকতা থাকলেও গত কয়েক দশকে বেড়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান। আবার একইভাবে বেড়েছে শিক্ষিত বেকার প্রতিবন্ধীর সংখ্যাও।
সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত আফিয়া কবীর আনিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শর্ত সাপেক্ষে। তাঁর পরীক্ষায় ফলের গ্রেড ‘ই’ থাকায় শিকার হতে হয় প্রতিবন্ধকতার। বলা হয়, আপাতত ভর্তি করা হলেও ‘ই’ গ্রেড পরিবর্তন না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হবে। আনিলা বিষয়টি চ্যলেঞ্জ করে আদালতে রিট করেন। রিটে তিনি আদালতে বলেন, ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণের মতো সমতা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের না দেওয়া হলেও, কিছুটা হলেও সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আদালত আনিলার আবেদন অনুমোদন করায় এখন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ হচ্ছে। আনিলা বলেন, ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য তেমনভাবে প্রবেশগম্যতা তৈরি হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশগম্য ভবন, টয়লেট ও গণপরিবহন নেই। শিক্ষকদের পরামর্শও আমি সে কারণে অন্যদের মতো করে পাইনি।’
এমন অবস্থার মধ্যে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’ প্রতিপাদ্যে আজ রোববার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির এই সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এসডিজি অর্জন করতে প্রতিবন্ধীবান্ধব উদ্ভাবন প্রয়োজন।
আইনের বাস্তবায়ন নেই
২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন করা হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে ১০ বছর। কিন্তু এখনও এই আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন খুবই কম। এটুআই প্রকল্পের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন আমাদের অধিকার দিয়েছে। কোথাও গেলে এখন আমাদের করুণা চাইতে হয় না। আমরা বলতে পারি, এটা আমাদের অধিকার। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে। আইনটিকে আমরা স্বরূপে পাই না।’
প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের বিষয় পরিষ্কার উল্লেখ এবং এর বিধিমালা ও কর্মপরিকল্পনায় থাকলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে আজও। জানা যায়, ২০১২ সালে সরকারের উচ্চমহল থেকে বলা হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে যানবাহনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করা হবে। ২০১৮ পেরিয়ে ২০২৩ সালও শেষের দিকে। কিন্তু অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে প্রবেশগম্যতা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আইন হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যারা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শিক্ষা-কর্মে প্রবেশ করতে পারছে না। আবার ঝরেও পড়ছে প্রবেশগম্যতার অভাবে।’
অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট মোল্লা বলেন, ‘সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। জনশুমারিমতে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার।