
মায়ের সঙ্গে দুরন্ত চিতাল শাবক। সুন্দরবনের কচিখালি থেকে সম্প্রতি তোলা- লেখক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) সহকর্মীদের জন্য চলতি বছরের মার্চে সুন্দরবন ভ্রমণের আয়োজন করলাম। কিন্তু 'বাঘের বাড়ি'খ্যাত কটকার জামতলীতে গিয়েও তাদের অতি পরিচিত বাদামি দেহের সাদা ফোঁটাযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটি দেখাতে ব্যর্থ হলাম। অথচ ২০১৯ সালের বর্ষায় যখন এসেছিলাম, তখন খোদ বাঘের বাড়িতেই বাচ্চাকাচ্চাসহ ওদের দেখেছিলাম প্রচুর সংখ্যায়। মৌসুমের শেষ সময় হওয়ায় পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড়ে হয়তো খানিকটা আড়ালে চলে গেছে ওরা। জামতলীতে ব্যর্থ হয়ে কটকা ফরেস্ট অফিসের পাশে গেলাম। সেখানে বেশক'টি থাকলেও অতিরিক্ত মানুষ দেখে ওরাও সটকে পড়েছে। তবুও ভাগ্য ভালো বলতে হয়, শেষ পর্যন্ত একটি শিংওয়ালা পুরুষ প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল। তবে এত মানুষ দেখে সেও দ্রুত পালিয়ে গেল। পরদিন সকালে কটকা থেকে লঞ্চ ছাড়ল বাঘের বৈঠকখানাখ্যাত কচিখালির উদ্দেশে। কচিখালি পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। কাজেই এবার একটু অঙ্ক কষে নিলাম। দুপুরের খাবার সেরে দ্রুত নৌকা ছাড়লাম, যাতে অন্য বোটে আসা ট্যুরিস্টদের আগে আগে বাঘের বৈঠকখানায় পৌঁছতে পারি। তাহলে অন্তত ওদের দেখার একটা সুযোগ ঘটবে। সোজাসাপটা পথ অর্থাৎ ফরেস্ট অফিসের সামনে দিয়ে না গিয়ে কচিখালি খাল দিয়ে নৌকা ঢোকালাম। মাঝি বনের একটা সুবিধাজনক জায়গায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে লঞ্চের কাছে চলে গেল। কাজেই আমরাই সবার আগে বাঘের বৈঠকখানায় পৌঁছে গেলাম। আর কিছুক্ষণ হাঁটার পর ছন কাটার শ্রমিকদের জন্য ব্যবহূত ঘাট বাঁধানো পুকুরের আশপাশের ঘাসবনে ওদের অনেকটির দেখা পেলাম। তবে বেশি কাছে হওয়ায় দলগত ছবি তেমন রেঞ্জে আনতে পারলাম না। যাক, অবশেষে অন্তত আমার সহকর্মীদের আশা পূরণ হলো, এটাই বড় কথা।
কচিখালির বাদামি দেহের সাদা ফোঁটাযুক্ত এই স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো আর কেউ নয়, আমাদের অতি প্রিয় চিতাল বা চিত্রা হরিণ। এরা স্বর্ণমৃগ নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Spotted Deer, Axis Deer বা Indian Spotted Deer। হরিণের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে চিতালকেই সবচেয়ে সুন্দর বলা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে বংলাদেশের স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে সুন্দর বলে বিবেচিত। Cervidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Axis axis। রামায়ণের সীতা একে দেখেই মুগ্ধ হয়ে ধরে আনার জন্য রামকে অনুরোধ করেছিলেন। একসময় এ দেশের ব্যাপক এলাকাজুড়ে, বিশেষ করে বনাঞ্চলে, এদের যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন ছাড়া কোথাও দেখা মেলে না। অবশ্য বন বিভাগ সুন্দরবন থেকে কিছু হরিণ হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে ছেড়েছিল। ওখানে বাঘের মতো কোনো শিকারি প্রাণী না থাকায় ও খাদ্যের প্রাচুর্যতায় ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানের প্রকৃতিতে দেখা মেলে।
চিতালের দেহের দৈর্ঘ্য গড়ে ১.৫ মিটার ও কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা ০.৬-১.০ মিটার। হরিণের ওজন ৩০-৭৫ কেজি ও হরিণীর ২৫-৪৫ কেজি। দেহের লোম লালচে; তার ওপর সাদা ফোঁটা। এই রং একদিকে যেমন শিকারি প্রাণীদের হাত থেকে এদের আত্মগোপনে সাহায্য করে, তেমনি চোরা শিকারিদের লোভ-লালসার কারণও হয়। গলা ধবধবে সাদা। বুক ও দেহের নিচটা সাদাটে। হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত হালকা সাদা বা ধূসর। হরিণের শিং অত্যন্ত সুন্দর, যা প্রতি বছর ঝরে পড়ে। হরিণীর শিং নেই। নবজাতকের গায়ের রং বাদামি। কয়েক মাস পর্যন্ত গায়ে কোনো ফোঁটা দেখা যায় না, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা সৃষ্টি হতে থাকে।
চিতাল তৃণভোজী প্রাণী। সাধারণত ঘাস, লতাপাতা, গাছের পাতা ও বাঁকল খেয়ে জীবন ধারণ করে। সুন্দরবনের হরিণগুলো মূলত কেওড়া, বাইন, গেওয়া, গরান, গর্জন এবং কাঁকড়া গাছের চারা, পাতা ও বাঁকল খেয়ে থাকে। চরে নতুন জেগে ওঠা ঘাসের মধ্যে দূর্বা, নলখাগড়া, হোগলা, মারিয়া ইত্যাদি বেশি পছন্দ করে। সাধারণত সূর্য ওঠার আগে ও ডোবার পর খাবারের সন্ধানে বের হয়। আর সারাদিন জঙ্গলে বিশ্রাম করে।
সচরাচর ১০-১৫টি চিতাল মিলে দলবদ্ধভাবে থাকে। দলে দুই-তিনটি শক্তসমর্থ হরিণ থাকে। প্রজননের পূর্বে হরিণদের শক্তি পরীক্ষা চলে শিংয়ের গুঁতাগুঁতির মাধ্যমে। এ সময় কোনো কোনো হরিণের শিং খুলেও যেতে পারে। তবে দলের সবচেয়ে বলিষ্ঠ, শক্তিশালী ও দীপ্তমান হরিণের হাতেই থাকে কর্তৃত্ব। দলের সব হরিণীর ওপর থাকে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। বাকি হরিণগুলো দলপতির একান্ত অনুগত হিসেবে থাকে। যেহেতু সারা বছরই দলে থাকে তাই এদের মধ্যে মিলন (সধঃরহম) বেশি হয় ও সারা বছরই বাচ্চা জন্মায়। তবে মে থেকে আগস্ট মাসেই বেশিরভাগ প্রজনন ঘটে। হরিণী সাত-আট মাস গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। সাধারণত বর্ষার আগে আগে যখন সবুজ ঘাসের সমারোহ ঘটে এবং গাছের চারা, ঘাস ও লতাপাতায় বন ছেয়ে যায় তখন বেশিরভাগ হরিণীর বাচ্চা হয়। খাবারের প্রাচুর্য থাকায় এ সময় জন্মানো বাচ্চাগুলো বেশি তাজা থাকে। বুনো চিতালের আয়ুস্কাল ৯ থেকে ১৩ বছর।
লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
বিষয় : প্রাণিজগৎ
মন্তব্য করুন