২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে পরিচালিত গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত দুটি মামলা উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতাদের নিশানা করে ছোড়া গ্রেনেডে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
হত্যা ও বিস্ম্ফোরক দুই মামলায় বিচারিক আদালতে মোট ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
এখন বিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডগুলো অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চ নির্ধারণের নির্দেশনা চেয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে নথি উপস্থাপন করা হবে। চলতি বছরেই চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি যাতে হতে পারে সে লক্ষ্যে শুনানির জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে রাষ্ট্র্রপক্ষ।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, 'করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এখন আদালত খুলেছে। আমরা চাইছি, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মামলাটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করতে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে যাতে এ মামলাটি শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ থেকে উচ্চ আদালত ভেকেশনে (অবকাশকালীন ছুটি) যাবে, যেটি অক্টোবরের ১৯ তারিখ পর্যন্ত চলবে। তাই অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা শুনানি করে মামলাটি যাতে শেষ করা যায়- এটিই আমাদের লক্ষ্য।'
দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পলাতক আসামিদের দেশে ফেরত এনে রায় কার্যকর করার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, 'পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কলাকৌশল অব্যাহত রয়েছে। এগুলো প্রকাশ্যে এলে তারা সুযোগ পাবে। আমরা চেষ্টা করছি, পলাতক আসামিদের দণ্ড অবশ্যই কার্যকর করা হবে।'
১৭ বছর আগের ওই বিভীষিকাময় ঘটনায় হত্যা ও বিস্ম্ফোরক আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃত্যুদ প্রাপ্ত ১৯ আসামির করা আপিল হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ।
সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, গ্রেনেড হত্যা মামলায় ১৩টি ভলিউমে মোট ৫৮৫টি পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে, যা প্রায় সাড়ে দশ হাজার পৃষ্ঠার। এর মধ্যে আপিল ২২টি ও জেল আপিল ১২টি। অন্যদিকে বিস্ম্ফোরক মামলায় ১১টি ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপারবুকের পরিসর দশ হাজার পৃষ্ঠা। এর মধ্যে আপিল ১৭টি ও জেল আপিল ১২টি। প্রায় সাড়ে ২০ হাজার পৃষ্ঠার এক হাজার ৮০টি পেপারবুক সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস) তৈরির পর গত বছরের ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সংশ্নিষ্ট শাখায় জমা হয়। বর্তমানে মামলার মূল নথির সঙ্গে পেপারবুক যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।
রাষ্ট্রপক্ষে ডেথ রেফারেন্স সংক্রান্ত আবেদনের শুনানির বিষয়ে দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সমকালকে বলেন, 'মামলার পেপারবুক প্রস্তুত রয়েছে। আশা করছি দ্রুত মামলাটির শুনানি শুরু করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্র্রপক্ষ সেভাবেই শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। চলতি বছরই যাতে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য।'
পলাতক আসামিদের মামলা শুনানির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'বিচারিক আদালতে পলাতকদের পক্ষে রাষ্ট্র্রনিযুক্ত আইনজীবী মামলা পরিচালনা করেছেন। এখানে হাইকোর্টেও পলাতকদের ক্ষেত্রে শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রেফারেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর প্রয়োজন হবে। বিধি অনুযায়ী এটিও আদালত নির্ধারণ করে দেবেন।'
মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পরবর্তী ধাপ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান সমকালকে বলেন, 'এখন পেপারবুকের সঙ্গে মামলা দুটি মূল নথি মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এ কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগির আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে বিধি অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালত পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড হলে তা হাইকোর্টে অনুমোদন করাতে হয়। রায়সহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলার সব নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয় যা 'ডেথ রেফারেন্স' নামে পরিচিত। হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পেপারবুক তৈরি করলে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরা হয়।
আইনজীবীরা বলছেন, পেপারবুকে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, জব্দ তালিকা, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও বিচারিক আদালতের রায় পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখ্য আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, 'হাইকোর্টে প্রতিটি সাক্ষ্য পর্যালোচনা করা হয় চুলচেরা বিশ্নেষণের মাধ্যমে। সাক্ষীদের পারস্পরিক বক্তব্যের মধ্যে কোনো ধরনের বৈপরীত্য আছে কিনা, বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ের ব্যাখ্যা বিশ্নেষণ যথাযথ কিনা এবং এর ভিত্তি কী, ঘটনা ও অপরাধ সংশ্নিষ্ট আইন ও দেশি-বিদেশি মামলার নজিরসহ (রায়) অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। এর সঙ্গে আসামিদের অনেকগুলো আপিলও আছে। কাজেই সব মিলিয়ে এই মামলার শুনানিতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।'
দ্রুততার নজির :চাঞ্চল্যকর ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে নিষ্পত্তির নজির নতুন নয়। আগেও এ ধরনের মামলাগুলোতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের আগে বিজি প্রেস থেকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সব পেপারবুক প্রস্তুত করাতেন। তবে চাঞ্চল্যকর বিডিআর হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেপারবুক তৈরির উদ্যোগ নেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরির পর গত ১১ বছরে কমপক্ষে ২০টি চাঞ্চল্যকর মামলা হাইাকোর্টে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলা, সৌদি রাষ্ট্রদূত খালাফ হত্যা মামলা, সিলেটের শিশু সামিউল আলম রাজন ও খুলনার শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলা, রাজধানীর মালিবাগে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান হত্যা মামলা, চট্টগ্রামের আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা অন্যতম। কয়েকটি মামলা আপিল বিভাগেও ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিশেষ বেঞ্চ :হাইকোর্টে বর্তমানে ২০১৬ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি চলছে। করোনা পরিস্থিতিতে তিনটি বিশেষ বেঞ্চে মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি হচ্ছে। গ্রেনেড হামলার মামলাটি ২০১৮ সালে হাইকোর্টে নথিভুক্ত হওয়ায় ক্রমানুসারে আরও চার বছর পর শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসার কথা। তবে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে দ্রুত এই মামলার পেপারবুক তৈরি হওয়ায় চলতি বছরেই এর শুনানি শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে মৃত্যুদ প্রাপ্ত প্রায় দুই হাজার আসামির আপিল বর্তমানে উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
দণ্ডিতরা কে কোথায় : দণ্ডিত মোট ৪৯ আসামির মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, লে.কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩১ জন এখন কারাগারে আছেন। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জন মামলার নথি অনুযায়ী পলাতক। তাদের মধ্যে তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে আছেন। অন্যদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে প্রথমে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তদন্ত পর্যায়ে 'জজ মিয়া নাটক' ইত্যাদি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পুনর্তদন্ত ও চার্জশিট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আদালতের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত ও তারেক রহমানসহ ৩০ আসামিকে যুক্ত করে ২০১১ সালে সম্পূরক চার্জশিটসহ কয়েক ধাপে মামলাটি পরিণতি পেয়েছে। মোট আসামির সংখ্যা হয়েছিল ৫২। এর মধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামী নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় হুজি নেতা আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদ কার্যকর হয়ে যাওয়ায় রায়ের আগেই এই তিন নাম বাদ পড়ে।
বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়, এ হামলার প্রস্তুতিপর্বে হাওয়া ভবনের বৈঠকে তারেক রহমান জঙ্গিদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। হামলার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারিক আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। তারপর তা হাইকোর্টে পাঠানো হয়।